ইসলাম লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইসলাম লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

০১ মার্চ ২০২৩

৩২৮।।তারা জাহান্নামে থাকবে চিরকাল।

 আল কুরআন, ২-বাক্বারা

(2:74)

অনুবাদ:    কিন্তু এ ধরনের নিশানী দেখার পরও তোমাদের দিল কঠিন হয়ে গেছে, পাথরের মত কঠিন বরং তার চেয়েও কঠিন। কারণ এমন অনেক পাথর আছে যার মধ্য দিয়ে ঝরণাধারা প্রবাহিত হয় আবার অনেক পাথর ফেটে গেলে তার মধ্য থেকে পানি বের হয়ে আসে, আবার কোন কোন পাথর আল্লাহর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পড়েও যায়। আল্লাহ‌ তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে বেখবর নন।

(2:75)

অনুবাদ:    হে মুসলমানরা! তোমরা কি তাদের থেকে আশা করো তারা তোমাদের দাওয়াতের ওপর ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দলের চিরাচরিত রীতি এই চলে আসছে যে, আল্লাহর কালাম শুনার পর খুব ভালো করে জেনে বুঝে সজ্ঞানে তার মধ্যে ‘তাহরীফ’ বা বিকৃতি সাধন করেছে।

(2:76)

অনুবাদ:    (মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহর ওপর) যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে সাক্ষাত হলে বলে, আমরাও তাঁকে মানি। আবার যখন পরস্পরের সাথে নিরিবিলিতে কথা হয় তখন বলে, তোমরা কি বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেলে? এদেরকে তোমরা এমন সব কথা বলে দিচ্ছো যা আল্লাহ‌ তোমাদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন, ফলে এরা তোমাদের রবের কাছে তোমাদের মোকাবিলায় তোমাদের একথাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করবে?

(2:77)

অনুবাদ:    এরা কি জানে না, যা কিছু এরা গোপন করছে এবং যা কিছু প্রকাশ করছে সমস্তই আল্লাহ‌ জানেন?

(2:78)

অনুবাদ:    এদের মধ্যে দ্বিতীয় একটি দল হচ্ছে নিরক্ষরদের। তাদের কিতাবের জ্ঞান নেই, নিজেদের ভিত্তিহীন আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়ে বসে আছে এবং নিছক অনুমান ও ধারণার ওপর নির্ভর করে চলছে।

(2:79)

অনুবাদ:    কাজেই তাদের জন্য ধ্বংস অবধারিত যারা স্বহস্তে শরীয়াতের লিখন লেখে তারপর লোকদের বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। এভাবে তারা এর বিনিময়ে সামান্য স্বার্থ লাভ করে। তাদের হাতের এই লিখন তাদের ধ্বংসের কারণ এবং তাদের এই উপার্জনও তাদের ধ্বংসের উপকরণ।

(2:80)

অনুবাদ:    তারা বলে, জাহান্নামের আগুন আমাদের কখনো স্পর্শ করবে না, তবে কয়েক দিনের শাস্তি হলেও হয়ে যেতে পারে। এদেরকে জিজ্ঞেস করো, তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার নিয়েছো, যার বিরুদ্ধাচারণ তিনি করতে পারেন না? অথবা তোমরা আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিয়ে এমন কথা বলছো যে কথা তিনি নিজের ওপর চাপিয়ে নিয়েছেন বলে তোমাদের জানা নেই? আচ্ছা জাহান্নামের আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে না কেন?

(2:81)

অনুবাদ:    যে ব্যক্তিই পাপ করবে এবং পাপের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে সে-ই জাহান্নামী হবে এবং জাহান্নামের আগুনে পুড়তে থাকবে চিরকাল।

(2:82)

অনুবাদ:    আর যারা ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে থাকবে তারা চিরকাল।



৩২৭।।তারা(দেবতারা) আমার উপকারে আসবে না।

 আল কুরআন, ৩৬  ইয়া-সীন, আয়াত: ২৩

তাঁকে বাদ দিয়ে কি আমি অন্য উপাস্য বানিয়ে নেবো? অথচ যদি দয়াময় আল্লাহ‌ আমার কোন ক্ষতি করতে চান তাহলে তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজে লাগবে না এবং তারা আমাকে ছাড়িয়ে নিতেও পারবে না। 



২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

৩২৬।। আল কুরআন সুরা নসর ও ইখলাস

 রাসুলুল্লাহ সাঃ এর জীবন সায়াহ্ন ও বেশি বেশি ইবাদতে মশগুল থাকার হুকুম।আমাদের বয়স হলে তাই করা উচিত।

আল কুরআন, ১১০-নাসর

(110:0)

অনুবাদ:    পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে।

(110:1)

অনুবাদ:    যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয়,

(110:2)

অনুবাদ:    আর (হে নবী!) তুমি (যদি) দেখ যে লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করছে।

(110:3)

অনুবাদ:    তখন তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যি তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী।

+++++++++++

আল্লাহর একত্তবাদ ও পরিচয় 

আল কুরআন, ১১২-ইখলাম

(112:0)

অনুবাদ:    পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নাম।

(112:1)

অনুবাদ:    বলো, তিনি আল্লাহ, একক।

(112:2)

অনুবাদ:    আল্লাহ কারোর ওপর নির্ভরশীল নন এবং সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল।

(112:3)

অনুবাদ:    তাঁর কোন সন্তান নেই এবং তিনি কারোর সন্তান নন।

(112:4)

অনুবাদ:    এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। 



২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

৩২৫।। সুরা ইখলাসের ফজিলত

 সুরা আল ইখলাস মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের ১১২ নম্বর সুরা। এর আয়াত সংখ্যা ৪। শব্দ সংখ্যা ১৫, অক্ষর ৪৭। এই সুরাতে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব ও সত্তার সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে। এটি কোরআনের অন্যতম ছোট সুরা হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে এই সুরা কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান বলা হয়। ইখলাস অর্থ গভীর অনুরাগ, একনিষ্ঠতা, নিরেট বিশ্বাস, খাঁটি আনুগত্য। শিরক থেকে মুক্ত হয়ে তাওহিদ বা এক আল্লাহর ওপর খাঁটি ও নিরেট বিশ্বাসী হওয়াকে ইখলাস বলা হয়।


মুশরিকরা হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে আল্লাহর বংশপরিচয় জিজ্ঞেস করেছিল, যার জবাবে এই সুরা নাজিল হয়। কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে যে তারা আরও প্রশ্ন করেছিল, আল্লাহ তাআলা কিসের তৈরি—স্বর্ণ-রৌপ্য অথবা অন্য কিছুর? এর জবাবে সুরাটি অবতীর্ণ হয়েছে।


সুরা ইখলাসের ফজিলত অনেক। সুরা ইখলাস যিনি ভালোবাসবেন, তিনি জান্নাতে যাবেন। হাদিসে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কাছে এসে আরজ করলেন, আমি এই সুরাকে ভালোবাসি, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সুরা ইখলাসের প্রতি ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে দাখিল করবে। (মুসনাদে আহমদ ৩/১৪১)


কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ: হাদিসে এসেছে, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা সবাই একত্র হয়ে যাও, আমি তোমাদের কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ শোনাব। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) সুরা ইখলাস পাঠ করলেন। (মুসলিম, তিরমিজি)


বিপদে-আপদে উপকারী: হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সকাল-বিকেল সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করে, তাকে বালা-মুসিবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট হয়। (আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ি)


রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুমানোর আগে কুলহু আল্লাহু আহাদ, কুল আউযু রাব্বিল ফালাক, কুল আউযু বিরাব্বিন নাস পড়ার কথা বলেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বিছানায় ঘুমানোর জন্য যেতেন, তখন তিনি তাঁর দুই হাতের তালু একত্র করতেন, তারপর সেখানে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। এরপর দুই হাতের তালু দিয়ে শরীরে যতটুকু সম্ভব হাত বুলিয়ে দিতেন। এভাবে তিনবার করতেন। (বুখারি, আবু দাউদ, তিরমিজি)


সুরা ইখলাসের অর্থ


বলুন, তিনি আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়


আল্লাহ কারও ওপর মুখাপেক্ষী নন এবং সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী।


তাঁর কোনো সন্তান নেই এবং তিনি কারও সন্তানও নন

এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।


ইসলামের মূল জিনিসটাই হচ্ছে তাওহিদ। এ সুরায় শেখানো হয়, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তিনি কারও থেকে জন্ম নেননি, কোনো কিছুর সমতুল্য নন তিনি। কোরআন শরিফ আমাদের তিনটি মৌলিক জিনিস শেখায়—তাওহিদ, আখিরাত ও রিসালাত। অর্থাৎ আল্লাহ, পরকাল ও অহি। অন্য যেকোনো বিশ্বাস এই তিনটার মধ্যে পড়ে যায়। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের বিশ্বাস, আল্লাহর প্রেরিত অহির প্রতি বিশ্বাস। যখন আমরা বলি আল্লাহকে বিশ্বাস করি, এর মধ্যে আল্লাহর সব নাম, সব গুণ, কাজকে বোঝায়। যখন বলি, আখিরাতে বিশ্বাস, তার মধ্যে কবরের জীবন, বিচার দিবস, জান্নাত, জাহান্নাম—সব এসে যায়। তো এভাবে যদি চিন্তা করি, তাহলে বোঝা যায়, বিশ্বাসের এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কথাই বর্ণিত হয়েছে এই সুরাতে। আপনি যদি শুধু বোঝেন যে এই সুরাতে কী বলা হয়েছে, তাহলে দ্বীনের পথচলা শুরু করার মূলটা আপনি ধরতে পেরেছেন। সহিহ হাদিসে আছে, সুরা ইখলাস তিনবার পাঠ করলে এক খতম কোরআন তিলাওয়াতের সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে, এক যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে আমির বা নেতা নিযুক্ত করে দেন, তিনি নামাজে ইমামতিকালে সুরা ফাতিহা ও অন্য সুরা শেষে প্রতি রাকাতেই সুরা ইখলাস পাঠ করতেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে লোকেরা এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে তিনি তাঁকে ডেকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন, নেতা উত্তর দেন যে এই সুরায় আল্লাহর পরিচয় পাই, তাই এই সুরাকে ভালোবাসি। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে আল্লাহও তোমাকে ভালোবাসেন।

হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি কাজ ইমানের সঙ্গে করতে পারবে জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করতে পারবে। (১) যে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেবে। (২) যে ব্যক্তি গোপন ঋণ পরিশোধ করবে। (৩) এবং যে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে (তাফসিরে কাসির)।

ফেরদৌস ফয়সাল: প্রথম আলোর হজ প্রতিবেদক
afef78@gmail.com

প্রথম আলো এর সৌজন্যে।








২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

আল কুরআন, ৯৬-আলাক্ব, বাংলা অনুবাদ।৩২৩নং পোস্ট:


(96:0)

অনুবাদ:    পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে


(96:1)

অনুবাদ:    পড়ো (হে নবী) , তোমার রবের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন।

(96:2)

অনুবাদ:    জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।

(96:3)

অনুবাদ:    পড়ো এবং তোমার রব বড় মেহেরবান,

(96:4)

অনুবাদ:    যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন।

(96:5)

অনুবাদ:    মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানতো না।


(96:6)

অনুবাদ:    কখনই নয়, মানুষ সীমালংঘন করে।

(96:7)

অনুবাদ:    কারণ সে নিজেকে দেখে অভাবমুক্ত।


(96:8)

অনুবাদ:    (অথচ) নিশ্চিতভাবেই তোমার রবের দিকেই ফিরে আসতে হবে।

(96:9)

অনুবাদ:    তুমি কি দেখেছো সেই ব্যক্তিকে, যে নিষেধ করে

(96:10)

অনুবাদ:    এক বান্দাকে, যখন সে নামায পড়ে।


(96:11)

অনুবাদ:    তুমি কি মনে করো, যদি (সেই বান্দা) সঠিক পথে থাকে

(96:12)

অনুবাদ:    অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়?

(96:13)

অনুবাদ:    তুমি কি মনে করো, যদি (এই নিষেধকারী সত্যের প্রতি) মিথ্যা আরোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়?

(96:14)

অনুবাদ:    সে কি জানে না, আল্লাহ‌ দেখছেন?


(96:15)

অনুবাদ:    কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয় তাহলে আমি তার কপালের দিকে চুল ধরে তাকে টানবো,

(96:16)

অনুবাদ:    সেই কপালের চুল (ওয়ালা) যে মিথ্যুক ও কঠিন অপরাধকারী।

(96:17)

অনুবাদ:    সে তার সমর্থক দলকে ডেকে নিক

(96:18)

অনুবাদ:    আমি ডেকে নিই আযাবের ফেরেশতাদেরকে।



(96:19)



অনুবাদ:    কখনই নয়, তার কথা মেনে নিয়ো না, তুমি সিজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো।


০৪ জুন ২০২১

ইসলামে মানব জীবনের নিরাপত্তা

    পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে আল্লাহ নিরাপদ মানবজীবনকে তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা যেন ইবাদত করে এই ঘরের প্রতিপালকের, যিনি তাদের ক্ষুধায় অন্ন দেন এবং ভয় থেকে নিরাপত্তা দেন।’ (সুরা : কুরাইশ, আয়াত : ৩-৪)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুমের সঙ্গে মিশ্রণ করেনি, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা : আনআন, আয়াত : ৮২)
 

ইসলামে নিরাপত্তার ধারণা:

ইসলামে নিরাপত্তার ধারণা বিস্তৃত ও ব্যাপক। শরিয়তের প্রধান পাঁচটি ‘মাকসাদ’ বা উদ্দেশ্য হলো মানবজীবনের পাঁচটি বিষয়ের নিরাপত্তা প্রদান। তা হলো—ধর্মবিশ্বাস, জীবন, সম্পদ, বংশধারা ও মেধা-বুদ্ধি। সুতরাং ইসলামী আইন মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন ও সম্পদ, সম্মান ও সম্ভ্রম, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস থেকে নিরাপত্তার বিস্তৃত ধারণা লাভ করা যায়। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে লোক পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদে সকালে উপনীত হয়, সুস্থ শরীরে দিনাতিপাত করে এবং তার কাছে সারা দিনের খোরাকি থাকে, তবে তার জন্য যেন গোটা দুনিয়াটাই একত্র করা হলো।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪৬)
 
পাঁচ বিষয়ের নিরাপত্তা সবার আগে :

 যার প্রত্যেকটি মৌলিক মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত এবং যা ব্যাপকার্থে জীবনের সব দিক অন্তর্ভুক্ত করে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পাঁচটি বিষয় হলো—
 

1. দ্বিন বা ধর্মের নিরাপত্তা : ধর্মের নিরাপত্তার অর্থ আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাস ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ শরিয়ত পরিপালনের নিশ্চয়তা। ইসলামী আকিদা লালন ও শরিয়ত পালনে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে তা দূর করা। শরিয়ত যেমন মুমিনের ধর্মীয় জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়, তেমনি শর্ত সাপেক্ষে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং নামাজ আদায় করতে ও জাকাত দিতে। এটাই সঠিক দ্বিন।’ (সুরা : বাইয়িনাহ, আয়াত : ৫)
  2.  জীবনের নিরাপত্তা : মানবজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শরিয়ত সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কঠোর বিধান প্রণয়ন করেছে। জীবনের নিরাপত্তা বলতে শুধু প্রাণ রক্ষা নয়; বরং জীবনের স্থিতিশীল, সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের প্রয়োজনীয় সব কিছু এর অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য শরিয়ত যেমন বাহ্যত হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে, তেমনি যা কিছু মানবজীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় তাও নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা পরস্পরকে হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহশীল।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
  3.  মেধা-বুদ্ধির নিরাপত্তা : ইসলাম মানুষের মেধা, বুদ্ধি ও বিবেক-বোধকে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তা সংরক্ষণ ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ নষ্ট করে এমন বিষয় ইসলামে নিষিদ্ধ। এ কারণেই ইসলাম সব ধরনের নেশাদ্রব্য নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘শয়তান মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায়। তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৯১)
একই কারণে ইসলাম কুসংস্কার, অপশিক্ষা, জাদুকর ও গণকের কাছে যাওয়া ও শিরকি বিশ্বাসগুলো নিষিদ্ধ করেছে। কেননা এসব বিশ্বাস ও কাজ মানুষের মেধা, বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধকে সঠিক পথে এগোতে দেয় না।
  4.  বংশধারার নিরাপত্তা : মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষায় মানুষের বংশধারা টিকিয়ে রাখা আবশ্যক। অন্যদিকে মানুষের স্বভাব-চরিত্রে তার বংশীয় ধারার প্রভাব বিদ্যমান। ইসলাম মানুষের বংশধারা টিকিয়ে রাখতে এবং জিনগত বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখতে বিয়ের বিধান দিয়েছে। ধর্ষণ, ব্যভিচার ও ভ্রূণ হত্যার মতো যেসব অপরাধ মানবজাতির বংশীয় পরম্পরাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় তা নিষিদ্ধ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে তোমাদের যাকে ভালো লাগে, দুই, তিন অথবা চার; আর যদি আশঙ্কা করো যে সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তানদের হত্যা কোরো না। তাদের আমিই রিজিক দিই এবং তোমাদেরও। নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মহাপাপ।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩১)
  5. সম্পদের নিরাপত্তা : মানবজীবনে সম্পদের গুরুত্ব অনেক। ইসলাম মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেছে। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ আত্মসাৎ করা নিষিদ্ধ। শরিয়ত সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি ও অপদখলকে অপরাধ আখ্যা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না; তবে পারস্পরিক সন্তোষের ভিত্তিতে ব্যবসা করা বৈধ। পরস্পরকে হত্যা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
 
আল্লাহর অবাধ্যতায় জীবন অনিরাপদ হয়:

   আল্লাহর আনুগত্য যেমন জীবন ও সমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তেমনি আল্লাহর অবাধ্যতা সমাজকে অনিরাপত্তা ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, যেখানে আসত সর্বদিক থেকে তার জন্য জীবনোপকরণ। অতঃপর সে (জনপদ) আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করল, ফলে তারা যা করত তজ্জন্য তাদের আস্বাদন করালেন ক্ষুধা ও ভীতির স্বাদ।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১১২)
 
নিরাপদ জীবন লাভের উপায়:

  মানবজীবনের যাবতীয় নিরাপত্তার মালিক আল্লাহ। আর তা নিশ্চিত হয় আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ ও শরিয়ত অনুশীলনের মাধ্যমে। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর কাছে মক্কা নগরীর নিরাপত্তার দোয়া করে বলেন, ‘স্মরণ করো! যখন ইবরাহিম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! এটাকে (মক্কা) নিরাপদ নগর করো এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনে তাদের ফলমূল থেকে জীবিকা প্রদান করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ নিরাপদ জীবন লাভের উপায় সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, ...ভয়ভীতির পরিবর্তে তাদের অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন।’
(সুরা : নুর, আয়াত : ৫৫)

Source : Kaler Kantha

০১ ফেব্রুয়ারী ২০২১

তিন বৎসর, ‘শিয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরিসংকটে অন্তরীণাবস্থা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

একঘরে করা

অত্যাচার উৎপীড়নের অঙ্গীকার 

মুশরিকদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো এবং তারা দেখতে পেল যে, বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের মুসলিম ও কাফির সকলের সম্মিলিতভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সাহায্যদানের অঙ্গীকার করেছে। এ সব কারণে মুশরিকদের হতবুদ্ধিতা আরো বেড়ে গেল।
পূর্বোলি­খিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুশরিকগণ ‘মুহাসসাব’ নামক উপত্যকায় খাইফে বনী কিনানাহর ভিতরে একত্রিত হয়ে সর্বসম্মতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হল যে, বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের সাথে ক্রয় বিক্রয়, সামাজিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, কুশল বিনিময় ইত্যাদি সবকিছুই বন্ধ রাখা হবে। কেউ তাদের কন্যা গ্রহণ করতে কিংবা তাদের কন্যা দান করতে পারবে না। তাদের সঙ্গে উঠাবসা, কথোপকথন মেলামেশা, বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কোনকিছুই করা চলবে না। হত্যার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যতদিন তাদের হাতে সমর্পণ না করা হবে ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
মুশরিকগণ এ বর্জন বা বয়কটের দলিলস্বরূপ একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, তারা কখনো বনু হাশিমের পক্ষ হতে কোন সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না এবং তাদের প্রতি কোন প্রকার ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে না, যে পর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার জন্য মুশরিকগণের হাতে সমর্পন না করবে সে পর্যন্ত এ অঙ্গীকার নামা বলবৎ থাকবে।
ইবনে কাইয়ূমের বর্ণনা সূত্রে বলা হয়েছে যে, এ অঙ্গীকারপত্রখানা লিখেছিলেন মানসুর বিন ইকরামা বিন ‘আমির বিন হাশিম। কেউ কেউ উল্লে­খ করেছেনে যে, এ অঙ্গীকার নামা লিখেছিলেন নাযর বিন হারিস। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এ অঙ্গীকার নামার সঠিক লেখক ছিলেন বোগায়েয বিন ‘আমির বিন হাশিম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার প্রতি বদ দোওয়া করেছিলেন যার ফলে তার হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল।[1]
যাহোক এ অঙ্গীকার স্থিরীকৃত হল এবং অঙ্গীকারনামাটি ক্বাবা’হর দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হল। যার ফলে আবূ লাহাব ব্যতীত বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের কী কাফের, কী মুসলিম সকলেই আতঙ্কিত হয়ে ‘শেয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরি সংকটে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়ত সপ্তম বর্ষের মুহারম মাসের প্রারম্ভে চাঁদ রাত্রিতে। তবে এ ঘটনা সংঘটনের সময়ের ব্যাপারে আরো মতামত রয়েছে।

# যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ।

 

 

 

তিন বৎসর, ‘শিয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরিসংকটে অন্তরীণাবস্থা 

এ বয়কটের ফলে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের লোকজনদের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন ও সঙ্গীন হয়ে পড়ল। খাদ্য-শস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব-সামগ্রী আমদানী ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ হয়েছিল। কারণ, খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী যা মক্কায় আসত মুশরিকগণ তা তাড়াহুড়া করে ক্রয় করে নিত। এ কারণে গিরি সংকটে অবরুদ্ধদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়ল। খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা, চামড়া ইত্যাদি খেতে বাধ্য হল। কোন কোন সময় তাঁদের উপবাসেও থাকতে হতো। উপবাসের অবস্থা এরূপ হয়ে যখন মর্মবিদারক কণ্ঠে ক্রন্দন করতে থাকত তখন গিরি সংকটে তাঁদের নিকট জিনিসপত্র পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব পড়েছিল, যা পৌঁছত তাও অতি সঙ্গোপনে। হারাম মাসগুলো ছাড়া অন্য কোন সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাহিরে যেতে পারতেন না। অবশ্য যে সকল কাফেলা মক্কার বাহির থেকে আগমন করত তাদের নিকট থেকে তাঁরা জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু মক্কার ব্যবসায়ীগণ এবং লোকজনেরা সে সব জিনিসের দাম এতই বৃদ্ধি করে দিত যে, গিরিসংকটবাসীগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই তা থেকে যেত।
খাদীজাহ (রাঃ)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম বিন হিযাম কখনো কখনো তাঁর ফুফুর জন্য গম পাঠিয়ে দিতেন। এক দিবস আবূ জাহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেলে সে খাদ্যশস্য নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দিতে উদ্যত হল, কিন্তু আবুল বোখতারী এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করল এবং তার ফুফুর নিকট খাদ্য প্রেরণে সাহায্য করল।
এ দিকে আবূ ত্বালিব রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কিত সর্বক্ষণ চিন্তিত থাকতেন। তাঁর নিরাপত্তা বিধানের কারণে লোকেরা যখন নিজ নিজ শয্যায় শয়ন করত তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে নিজ শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন। উদ্দেশ্য এই ছিল যে, কেউ যদি তাঁকে হত্যা করতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে সে দেখে নিক যে, তিনি কোথায় শয়ন করেন। তারপর যখন লোকজনেরা ঘুমিয়ে পড়ত তিনি তাঁর শয্যাস্থল পরিবর্তন করে দিতেন। নিজ পুত্র, ভাই কিংবা ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ্যথেকে এক জনকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন এবং তার পরিত্যাজ্য শয্যায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শয়নের ব্যবস্থা করতেন।
এ অবরুদ্ধ অবস্থা সত্ত্বেও হজ্বের সময় নাবী কারীম (সাঃ) এবং অন্যান্য মুসলিমগণ গিরি সংকট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেন এবং হজ্বব্রত পালনে আগত ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। সে সময় আবূ লাহাবের কার্যকলাপ যা ছিল সে সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। 

 

 

 

অঙ্গীকারনামা বিনষ্ট

এরূপ অবর্ণনীয় সংকটময় অবস্থায় দীর্ঘ দু’ বা তিন বছর অতিক্রান্ত হল। এরপর নবুওয়াত ১০ম বর্ষের মুহাররম মাসে[1] লিখিত অঙ্গীকারনামাটি ছিন্ন করে ফেলা হয় এবং অত্যাচার উৎপীড়নের পরিসমাপ্তিত ঘটানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কারণ, প্রথম থেকেই কিছু সংখ্যক ছিল এর বিপক্ষে। যারা এর বিপক্ষে ছিল তারা সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকত একে বাতিল কিংবা বিনষ্ট করার জন্য। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বছর দুয়েক অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহর রহমতে সেই একরারনামা বিনষ্ট করার মোক্ষম এক সুযোগ এসে যায় অবলীলাক্রমে।
এর প্রকৃত উদ্যোক্তা ছিলেন বনু ‘আমির বিন লুঈ গোত্রের হিশাম বিন ‘আমর নামক এক ব্যক্তি। রাতের অন্ধকারে এ ব্যক্তি গোপনে গোপনে ‘শেয়াবে আবূ ত্বালিব’ গিরি সংকটের ভিতরে খাদ্য শস্যাদি প্রেরণ করে বনু হাশিমের লোকজনদের সাহায্য সহানুভূতি করতেন। এ ব্যক্তি এক দিন যুহাইর বিন আবূ উমাইয়া মাখযুমীর নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। যুহায়েরের মাতা আতেকা হলেন আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা এবং আবূ ত্বালীবের ভগ্নী। তিনি যুহাইরকে সম্বোধণ করে বললেন, যুহাইর! ‘তুমি এটা কিভাবে বরদাস্ত করছ যে, আমরা উদর পূর্ণ করে তৃপ্তি সহকারে আহার করছি, উত্তম বস্ত্রাদি পরিধান করছি আর বনু হাশিম খাদ্যাভাবে, বস্ত্রাভাবে, অর্থাভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন যাপন করছে। বর্তমানে তোমার মামা বংশের যে অবস্থা চলছে তা তুমি ভালভাবেই জানো।’ বনু হালীমাহর কথা শুনে ব্যথা-বিজড়িত কণ্ঠে যুহাইর বললেন, ‘সব কথাই তো ঠিক, কিন্তু এ ব্যাপারে একা আমি কী করতে পারি? তবে হ্যাঁ, আমার সঙ্গে যদি কেউ থাকত তাহলে অবশ্যই আমি এ একরারনামা ছিঁড়ে ফেলার ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম’’। হিশাম বলল, ‘বেশতো, এ ব্যাপারে আমি আছি তোমার সঙ্গে।’ যুহাইর বলল, বেশ, তাহলে এখন তৃতীয় ব্যক্তির অনুসন্ধান করো।’
এ প্রেক্ষিতে হিশাম, মুত্ব’ঈম বিন আদীর নিকটে গেলেন। মুত্ব’ঈম বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের সম্পর্ক সূত্রে আবদে মানাফের সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হিশাম তাঁদের বংশীয় সম্পর্কের কথা উল্লে­খ করে তাঁকে ভৎর্সনা করার পর  ‘বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের দারুণ দুঃখ-দুর্দশার কথা উল্লে­খ করে বললেন, ‘বংশীয় ব্যক্তিদের এত দুঃখ, কষ্টের কথা অবগত হওয়া সত্ত্বও তুমি কিভাবে কুরাইশদের সমর্থন করতে পার?’ মুত্ব’ঈম বললেন, ‘সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু আমি একা কী করতে পারি? ‘হিশাম বললেন, ‘আরও একজন রয়েছে।’ মুত্ব’ঈম জিজ্ঞাসা করলেন সে কে? হিশাম বললেন, ‘আমি’’। মুত্ব’ঈম বললেন, ‘আচ্ছা তবে তৃতীয় ব্যক্তির অনুসন্ধান করো’। হিশাম বললেন, ‘এটাও করেছি।’ বললেন, সে কে? উত্তরে বললেন, ‘যুহাইর বিন আবি উমাইয়া।’
মুত্ব’ঈম বললেন, ‘আচ্ছা তবে এখন চতুর্থ ব্যক্তির অনুসন্ধান করো’’। এ প্রেক্ষিতে হিশাম বিন ‘আমর আবুল বুখতারী বিন হিশামের নিকট গেলেন এবং মুতয়েমের সঙ্গে যেভাবে কথাবার্তা হয়েছিল তার সঙ্গেও ঠিক একইভাবে কথাবার্তা হল।
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা এর সমর্থক কেউ আছে কি?’ হিশাম বললেন হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কে? হিশাম বললেন, ‘যুহাইর বিন আবি উমাইয়া, মুত্ব’ঈম বিন আদী এবং আমি।’
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তবে এখন ৫ম ব্যক্তির খোঁজ করো। এবাবে হিশাম যামআ বিন আসওয়াদ বিন মুত্তালিব বিন আসাদের নিকট গেলেন এবং তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন বনু হাশিমের আত্মীয়তা এবং তাদের প্রাপ্যসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা যে কাজের জন্য আমাকে ডাক দিচ্ছ, সে ব্যাপারে আরও কি কারো সমর্থন আছে?
হিশাম ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর করে সকলের নাম বললেন। তারপর তাঁরা সকলে হাজূনের নিকট একত্রিত হয়ে এ মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন যে, কুরাইশগণের অঙ্গীকারপত্রখানা অবশ্যই ছিঁড়ে ফেলতে হবে। যুহাইর বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমিই সর্ব প্রথম মুখ খুলব।’
পূর্বের কথা মতো পর দিন প্রাতে সকলে মজলিসে উপস্থিত হলেন। যুহাইর শরীরে একজোড়া কাপড় ভালভাবে লাগিয়ে উপস্থিত হলেন। প্রথমে তিনি সাতবার বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ করে নিলেন। তারপর সমবেত জনগণকে সম্বোধন করে বললেন, ওহে মক্কাবাসীগণ! আমরা তৃপ্তি সহকারে উদর পূর্ণ করে খাওয়া-দাওয়া করব, উত্তম পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করব। আর বনু হাশিম ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় এবং আদান-প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি ততক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকতে পারি না, যতক্ষণ ঐ অন্যায় ও উৎপীড়নমূলক অঙ্গীকারপত্রখানা ছিঁড়ে ফেলা না হচ্ছে।
আবূ জাহল মাসজিদুল হারামের নিকটেই ছিল- সে বললো, তুমি ভুল বলছ। আল্লাহর শপথ! তা ছিঁড়ে ফেলা হবে না।
প্রত্যুত্তরে যাময়া বিন আসওয়াদ বলে উঠল, ‘আল্লাহর কসম! তুমি অধিক ভুল বলছ। কিসের অঙ্গীকারপত্র! ওটা লিখার ব্যাপারে আমাদের কোন সম্মতি ছিল না। আমরা ওতে সন্তুষ্টও ছিলাম না।’’
অন্য দিক থেকে আবুল বুখতারী সহযোগী হয়ে বলে উঠল,
‘‘যাময়া ঠিকই বলেছো। ঐ অঙ্গীকারপত্রে যা লেখা হয়েছিল তাতে আমাদের সম্মতি ছিল না এবং এখনো তা মান্য করতে আমরা বাধ্য নই।’
এর পর মুত্ব’ঈম বিন আদী বললেন, ‘তোমরা উভয়েই ন্যায্য কথা বলেছো। এর বিপরীত কথাবার্তা যারা বলেছো তারাই ভুল বলেছো। আমরা এ প্রতিজ্ঞাপত্র এবং ওতে যা কিছু লেখা রয়েছে তা হতে আল্লাহর সমীপে অসন্তোষ প্রকাশ করছি।
ওদের সমর্থনে হিশাম বিন ‘আমরও অনুরূপ কথাবার্তা বললেন।
এদের আলাপ ও কথাবার্তা শুনে আবূ জাহল বলল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, এ সব কথা আলাপ-আলোচনা করে বিগত রাত্রিতে স্থির করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত পরামর্শ এ স্থান বাদ দিয়ে অন্যত্র কোথাও করা হয়েছে।’
ঐ সময় আবূ ত্বালিবও পবিত্র হারামের এক প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর আগমনের কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এ অঙ্গীকারপত্র সম্পর্কে এ সংবাদ দিয়েছিলেন যে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা এক প্রকার কীট প্রেরণ করেছেন যা অন্যায় ও উৎপীড়নমূলক এবং আত্মীয়তা বিনষ্টকারী অঙ্গীকার পত্রটির সমস্ত কথা বিনষ্ট করে দিয়েছে। শুধুমাত্র আল্লাহর নাম অবশিষ্ট রয়েছে। নাবী কারীম (সাঃ) তাঁর চাচা আবূ ত্বালিবকে এ কথা বলেছিলেন এবং তিনিও কুরাইশগণকে এ কথা বলার জন্য মসজিদুল হারামে আগমন করেছিলেন।
আবূ ত্বালিব কুরাইশগণকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহর তরফ থেকে আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের নিকট সংবাদ এসেছে যে, আপনাদের অঙ্গীকারপত্রটির সমস্ত লেখা আল্লাহ প্রেরিত কীটেরা নষ্ট করে ফেলেছে। শুধু আল্লাহর নামটি বর্তমান আছে। এ সংবাদটি আপনাদের নিকট পৌঁছানোর জন্য আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাকে প্রেরণ করেছেন। যদি তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে তাঁর ও আপনাদের মধ্য থেকে আমি সরে দাঁড়াব। তখন আপনাদের যা ইচ্ছে হয় করবেন। কিন্তু তাঁর কথা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে বয়কটদের মাধ্যমে আপনারা আমাদের প্রতি যে অন্যায় অত্যাচার করে আসছেন তা থেকে বিরত হতে হবে। এ কথায় কুরাইশগণ বললেন, ‘আপনি ইনসাফের কথাই বলছেন।’
এ দিকে আবূ জাহল এবং লোকজনদের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও বচসা শেষ হলে মুত্ব’ঈম বিন আদী অঙ্গীকার পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলার জন্য উঠে দাঁড়াল। তারপর সেটা হাতে নিয়ে সত্যি সত্যিই দেখা গেল যে, এক প্রকার কীট লেখাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছে। শুধু মাত্র ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ কথাটি অবশিষ্ট রয়েছে এবং যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম লেখা ছিল শুধু সেই লেখা গুলোই অবশিষ্ট রয়েছে। কীটে সেগুলো খায়নি।
তারপর অঙ্গীকার পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলা হল এবং এর ফলে বয়কটেরও অবসান ঘটল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং অন্যান্য সকলে শেয়াবে আবূ ত্বালিব থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মুশরিকগণ নাবী (সাঃ)-এর নবুওয়তের এক বিশেষ নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে চমৎকৃত হল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের আচরণের ক্ষেত্রে কোনই পরিবর্তন সূচিত হল না। যার উল্লে­খ এ আয়াতে করেছেন। ‏{‏وَإِن يَرَوْا آيَةً يُعْرِضُوْا وَيَقُوْلُوْا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ‏}‏ ‏[‏القمر‏:   ‏2‏]
‘‘কিন্তু তারা যখন কোন নিদর্শন দেখে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে- ‘এটা তো সেই আগের থেকে চলে আসা যাদু’।’ (আল-ক্বামার ৫৪ : ২)
তাই মুশরিকগণ বিমুখ হলে গেল এবং স্বীয় কুফরে তারা আরও কয়েক ধাপ অগ্রসর হয়ে গেল।

১। এর প্রমাণ হচ্ছে যে অঙ্গকার নামা ছিঁড়ে ফেলার ছয় মাস পর আবূ তালিবের মৃত্যু হয় এবং সঠিক কথা এটাই যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল রজম মাসে। যাঁরা একথা বলেন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল রমাযান মাসে তাঁরা একথাও বলেন যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল অঙ্গীকার নাম ছিন্ন করা ছয় মাস পরে নয় বরং আট মাস অথবা আরও কয়েক দিন পরে। উভয় প্রকার হিসেবেই অঙ্গীকারানাম ছিন্ন করার মাস হচ্ছে মুহারম।

২। বয়কটের এ বিস্তৃত বিবরণাদি নিম্নে বর্ণিত উৎস হতে চয়ন ও প্রণয়ন করা হয়েছে। সহীহুল বুখারী মক্কায় নাবাবী অবতরণ অধ্যায় ১ম খন্ড ২৬১ পৃঃ। বাবু তাকাসোমিল মুশরিকীন আলান্নাবীয়ে (সাঃ) ১ম খন্ড ৫৪৮ পৃঃ যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৫০-৩৫১ পৃঃ ও ৩৭৪-৩৭৭ পৃঃ। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৬৯-৭০ পৃঃ শাইখ আবদুল্লাহ রচিত ‘মুখতাসারুস সীরাহ ১০৬-১১০ পৃঃ। এবং শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রচিত ‘মুখতাসারুস সীরাহ ৬৮-৭৩ পৃঃ। এ উৎসসমূহে কিছু কিছু মতবিরোধ রয়েছে। প্রমাণাদির প্রেক্ষিতে আমি অগ্রাধিকার যোগ্য দিকটিই উল্লে­খ করেছি।

১৬ ডিসেম্বর ২০২০

নবী মুহাম্মাদ সঃ কে কেন এত ভালবাসি?

কেন এত ভালবাসি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে:

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন যে, প্রত্যেক নবীই যা চাওয়ার চেয়ে নিয়েছেন। অথবা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ প্রত্যেক নবীকে যে দু’আর অধিকার দেয়া হয়েছিল তিনি সে দু’আ করে নিয়েছেন এবং তা কবূলও করা হয়েছে। কিন্তু আমি আমার দু’আকে ক্বিয়ামতের দিনে আমার উম্মাতের শাফায়াতের জন্য রেখে দিয়েছি। [মুসলিম ১/৮৬, হাঃ ২০০, আহমাদ ১৩৭০৭] (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৮৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৭৫৩)
 

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬৩০৫
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত:

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে আমার শাফা’আত রয়েছে কাবীরা গুনাহের অপরাধীদের জন্য।

সহীহ, মিশকাত (৫৫৯৯), আয্‌যিলাল (৮৩১-৮৩২), রাওযুন নাযীর (৬৫)।

জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২৪৩৫
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

সুবহানাল্লাহ 
আলহামদুলিল্লাহ 
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ 
আল্লাহু আকবার 
লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ 
সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মালিকুল হাক্কুল মুবিন
ইয়া হাইয়ু ইয়া কাইয়ুম বিরাহমাতিকা আস্তাগিছ
ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির

লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জালিমীন

আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল জান্নাতা ওয়া আ'উযু বিকা মিনান্নার

আললাহুমমা  ইন্নি আউ’জুবিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া আনা আ’লামু ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা- লা- আ’লামু। (মুসনাদে আহমাদ, ছহিহ জামে)

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমার জানা অবস্থায় তোমার সাথে শিরক করা হতে তোমারই নিকট আশ্রয় চাই। আর অজানা অবস্থায় শিরক হয়ে গেলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

আস্তাগফিরুল্লাহ হাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম ওয়া আতুবু ইলাইহি

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহি ওয়াসাল্লিম তাসলিমা

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
কেয়ামতের দিন যখন আমাদের বাবা-মা ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ কারো কোন উপকারে আসবে না তখন একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য শাফায়াত করবেন। আমাদের উচিত বেশি বেশি তার উপর দরুদ শরীফ পাঠ করা। প্রতিদিন অন্তত 10 বার হলেও পাঠ করার নিয়ত করি। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন। আমিন

২৭ নভেম্বর ২০২০

একজন মুস‌লি‌মের কর্তব্য


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। 
আল কুরআন‌ে  আল্লাহ ব‌লেন ,67 -সুরা মুলক,( 67 :১ )" অতি মহান ও শ্রেষ্ঠ তিনি যাঁর হাতে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের কর্তৃত্ব। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতা রাখেন।

(67: ২  কাজের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীলও।
(67 :৩)   তিনিই স্তরে স্তরে সাজিয়ে সাতটি আসমান তৈরী করেছেন। তুমি রহমানের সৃষ্টকর্মে কোন প্রকার অসঙ্গতি দেখতে পাবে না। আবার চোখ ফিরিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি?
(67 :৪)   তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ক্লান্ত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে।"

আল্লাহ তাআলার ক্ষমাপ্রাপ্ত এবং মহা পুরস্কারের সুসংবাদপ্রাপ্ত মানুষের কতিপয় বৈশিষ্ট্য: 

৩৩: আল-আহযাব,:আয়াত: ৩৫,

اِنَّ الْمُسْلِمِیْنَ وَ الْمُسْلِمٰتِ وَ الْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ وَ الْقٰنِتِیْنَ وَ الْقٰنِتٰتِ وَ الصّٰدِقِیْنَ وَ الصّٰدِقٰتِ وَ الصّٰبِرِیْنَ وَ الصّٰبِرٰتِ وَ الْخٰشِعِیْنَ وَ الْخٰشِعٰتِ وَ الْمُتَصَدِّقِیْنَ وَ الْمُتَصَدِّقٰتِ وَ الصَّآئِمِیْنَ وَ الصّٰٓئِمٰتِ وَ الْحٰفِظِیْنَ فُرُوْجَهُمْ وَ الْحٰفِظٰتِ وَ الذّٰكِرِیْنَ اللّٰهَ كَثِیْرًا وَّ الذّٰكِرٰتِۙ اَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمْ مَّغْفِرَةً وَّ اَجْرًا عَظِیْمًا

নিশ্চয়ই -
১.মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, ২.মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, ৩. (আল্লাহর) হুকুমের অনুগত পুরুষ ও অনুগতা নারী, ৪.সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদিনী নারী, ৫.ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীলা নারী, ৬.রোজা পালনকারী পুরুষ ও রোজা পালনকারিণী নারী, ৭.নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী পুরুষ ও নারী, ৮.আল্লাহর জিকির তথা বেশি বেশি কোরআন অধ্যয়ন, স্মরণ ও অনুসরণকারী পুরুষ ও নারী- 

নিঃসন্দেহে এদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা ও মহাপুরস্কার ঠিক করে রেখেছেন।

ব্যাখ্যা-

১. মুসলিম বলতে জন্ম নিবন্ধন সনদের মুসলিম নয় বরং ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের বোঝানো হচ্ছে।

১.১জীবনের সকল ক্ষেত্রে জেনে বুঝে আন্তরিক বিশ্বাস সহকারে ইসলামী জীবন বিধানের অনুসরণকারী হতে হবে।

২. ঈমান হলো জ্ঞান যোগ বিশ্বাস । সুতরাং ভালোমতো না জেনে মুখে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করলেই মুমিন হওয়া যাবে কি?

৩. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা ফরজ। আল্লাহর বাণী তথা কোরআনে বর্ণিত সকল নির্দেশনাই মৌলিক । তাই সবার আগে আল্লাহর নির্দেশ নবীজির দেখানো পদ্ধতিতে পালন করতে হবে। মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে অমৌলিক বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না।

৪.সত্যবাদী হতে হবে ও কথা ও কাজের মাধ্যমে সত্যের সাক্ষ্য দিতে হবে।

৫.সকল বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও নিজের দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকতে হবে - অধৈর্য হলে চলবে না।

৬. অহংকার ও আত্মম্ভরিতা মুক্ত , দানশীল, রোজা পালনকারী, অশ্লীলতা পরিহার কারি হতে হবে

৭. সর্বোপরি আল কোরআন অধ্যয়ন, স্মরণ অনুসরণ করে অধিক মাত্রায় আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকতে হবে ।


উপরে বর্ণিত গুণাবলী সমূহ যথাযথভাবে জেনে সে অনুযায়ী নিজের ও প্রিয়জনদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন, প্রভু আমার।

 একজন মুস‌লিম হ‌বে আল্লাহর হুকুম পালন কারী, সত্যবাদী, ন্যায় পরায়ন, ন্যায় বিচারক, ওয়াদা রক্ষাকারী, দানকারী, তার জিহ্বা দ্বারা অন্য‌কে কষ্ট দি‌বে না, অন্যা‌য়ের প্র‌তিবাদকারী,  । সে জা‌নে আল্লাহ মানু‌ষের কর্মসমূহ লি‌পিবদ্ধ ক‌রে এবং সারা জীব‌নের যত ক্রিয়াকলাপ ভি‌ডিও আকা‌রে কিয়াম‌তের দিন বিচা‌রের সময় উপস্থাপন কর‌বেন ।আল্লাহ ব‌লেন, তি‌নি মানুষের খুব নিকবর্তী এবং সে যা ক‌রে তা দে‌খেন । এমন‌কি মানু‌ষের অন্ত‌রের খবর ও রা‌খেন ।  নি‌জের অপরাধ অস্বীকার কর‌লে মানু‌ষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তার বিরু‌দ্ধে স্বাক্ষী দি‌বে ।
   ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। তাই এটাকে আঁকড়ে ধরা আমাদের আবশ্যক ।ইসলামের মূল ভিত্তি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের উপর ঈমান আনা। না দেখে আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং তার হুকুম মান্য করাই হলো ঈমান। ইসলামে ঈমানের ভিত্তি পাঁচটি। ১। কালেমা ,২।  নামাজ, ৩। রোজা, ৪। যাকাত ও ৫। হজ্ব । 
১।কালেমা ঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। এর দ্বারা মুখে স্বীকার করা এবং অন্তরে বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ এক ও  অদ্বিতীয় এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল ।
মুমিনের জীবনে কালেমাঃ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ হলো ঈমানের কালেমা। কালেমার কিছু দাবি বা শর্ত  নিম্নে বর্ণনা করা হলো—
কালেমা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন : এ বিষয়ে জানা যে আল্লাহ ছাড়া সব উপাস্য অস্বীকার করে একমাত্র আল্লাহকে ইলাহ বলে স্বীকার করা  সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান থাকা। আল্লাহ  বলেন, ‘আর জেনে রেখো, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই।’ (সুরা : মুহাম্মাদ, আয়াত : ১৯) 
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেল যে জীবিত অবস্থায় সে জানত, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। অবশ্যই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ মুসলিম)
দৃঢ়বিশ্বাস  করা : কোনো ধরনের সন্দেহ ছাড়া ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর বিশ্বাস অন্তরে পূর্ণভাবে থাকতে হবে। কলেমাকে এমন পরিপূর্ণভাবে জানতে হবে, যাতে সংশয়-সন্দেহ না থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, সত্যিকারের মুমিন তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান এনেছে এবং ঈমান আনার পর তাতে কোনো ধরনের সন্দেহ পোষণ করে না।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৫) 
রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, আমি তাঁর রাসুল। যে ব্যক্তি এতে কোনো ধরনের সন্দেহ পোষণ না করে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে, সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ মুসলিম)
অন্তর ও মুখে স্বীকার করা : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর দাবি হলো, এই কলেমা মুখে ও অন্তরে স্বীকার করা। মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের যখন বলা হতো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তখন তারা অহংকার করত এবং বলত একজন পাগল কবির কথায় আমরা কি আমাদের উপাস্যগুলোকে পরিত্যাগ করব?’ (সুরা : সাফ্ফাত, আয়াত : ৩৫-৩৬) এ আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, মুমিনরা যেভাবে এ কলেমা মুখে উচ্চারণ করতেন, ঠিক তার বিপরীত কাফিররা তা বলতে অস্বীকার করত অহংকারের কারণে। কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে উচ্চারণ করার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, “আমাকে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত লোকেরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ না বলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে। যখন কেউ তা মেনে নেবে ও মুখে উচ্চারণ করবে, তখন তার জীবন ও সম্পদ আমার কাছে নিরাপদ। তবে ইসলামের যে হক বা দায়িত্ব আছে, তা আদায় করতে হবে এবং তার হিসাব নেবেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।” (বুখারি ও মুসলিম)
আত্মসমপর্ণ ও যথাযথ অনুসরণ করাঃ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তন করো এবং তাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করো।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৪)

 সত্যবাদী হওয়া : কলেমা পাঠকারী অন্তরে সর্বান্তকরণে কলেমা উচ্চারণ করা এবং এই দাবিতে সত্যবাদী হওয়া। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সাবধান করে বলেন, “আলিফ লাম-মিম। লোকেরা কি ভেবে নিয়েছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’—এ কথা বললেই তারা নিরাপদ হয়ে যাবে আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছিলাম; অতএব আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদের।” (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ১-৩)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কেউ খাঁটি অন্তরে সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসুল, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইখলাস : ইখলাস হচ্ছে নিয়ত বিশুদ্ধ করে যাবতীয় শিরক থেকে নিজেকে দূরে রেখে নেক আমল করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর আনুগত্যসহ ইবাদত করতে।’ (সুরা : বাইয়্যিনাহ, আয়াত : ৫)রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত পাওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে ওই ব্যক্তি, যে অন্তর থেকে ইখলাসের সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ স্বীকার করে।” (বুখারি)রাসুল (সা.) 
আরো বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।” (বুখারি)
কলেমার ভালোবাসা :  যেসব মুমিন ঈমানের দাবি মানবে, মানুষ শুধু তাদেরই ভালোবাসবে এবং যারা তা মানবে না, তাদের ঘৃণা করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,‘মানুষের মাঝে এমন লোকও আছে যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে যেমন ভালোবাসতে হয় তেমন তাদের ভালোবাসে। কিন্তু যারা প্রকৃত ঈমানদার, আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা আরো মজবুত।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৬৫)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি জিনিস যার মধ্যে আছে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ সে-ই পাবে : এক. তার অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি হবে। দুই. যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে শুধু আল্লাহর জন্যই ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে। তিন. ঈমানের পর কুফরির দিকে ফিরে যাওয়া তার কাছে এরূপ অপছন্দনীয়, যেরূপ আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপছন্দনীয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
তাগুতের প্রতি অবিশ্বাস : তাগুত হলো ওই সব বাতিল উপাস্য, আল্লাহকে ছাড়া যাদের উপাসনা করা হয়। সুতরাং কলেমা পাঠকারী এগুলো বর্জন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি তাগুতদের অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, নিশ্চয়ই সে এমন এক শক্ত বন্ধনকে আঁকড়ে ধরল, যা ছুটবার নয়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৬)রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্তর থেকে বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং আল্লাহ ছাড়া যেসব উপাস্যে উপাসনা করা হয় তা অস্বীকার করে, তার জীবন ও সম্পদ (নষ্ট করা) অন্যের জন্য হারাম।’ (সহিহ মুসলিম)
আমিন।

বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদসহ পাঁচ কালিম


কালেমা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সম্বলিত কয়েকটি আরবি পংক্তির নাম। এর মাধ্যমেই ইসলামের প্রথম স্তম্ভ পূর্ণতা পায়। ইসলামে কালমিার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক । কালিমার মূল অবকাঠামো হচ্ছে বিশ্বাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যায় যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক উপাস্য নেই সে জান্নাতে যাবে। 

 

এক.

কালিমা তাইয়্যেবা আরবি : لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ مُحَمَّدٌ رَسُوُل اللّهِ 

বাংলা উচ্চারণ: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। 

বাংলা অর্থ :   আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। 

 

দুই.

কালিমা শাহাদৎ আরবি :  اشْهَدُ انْ لّآ اِلهَ اِلَّا اللّهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه، وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدً اعَبْدُهوَرَسُولُه 

বাংলা উচ্চারণ: আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। 

বাংলা অর্থ :   আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি এক। তাঁহার কোন অংশীদার নেই, এবং আমি আরও সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, নিশ্চয়ই হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহ্র প্রেরিত বান্দা ও রাসূল। 

 

তিন.

কালিমা তামজীদ আরবি :  سُبْحَان لِلّه وَ الْحَمْدُ لِلّهِ وَ لآ اِلهَ اِلّا اللّهُ، وَ اللّهُ اَكْبَرُ وَلا حَوْلَ وَلاَ قُوَّة ِلَّا بِاللّهِ الْعَلِىّ الْعَظِيْم 

বাংলা উচ্চারণ: সুব্হানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আক্বার ওয়ালা হাওলা ক্বুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল্ আলিইল্ আযীম্। 

বাংলা অর্থ :   মহিমা ও সকল প্রসংশা আল্লাহ্র জন্য, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান, সর্বশক্তিমান ও সর্বক্ষমতাবান। আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ নয়। তিনিই মহান। 

 

চার.

কালিমা তাওহীদ আরবি :  لا الهَ اِلَّا اللّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيْكَ لَهْ، لَهُ الْمُلْكُ وَ لَهُ الْحَمْدُ يُحْى وَ يُمِيْتُ وَ هُوَحَىُّ لَّا يَمُوْتُ اَبَدًا اَبَدًا ط ذُو الْجَلَالِ وَ الْاِكْرَامِ ط بِيَدِهِ الْخَيْرُ ط وَهُوَ عَلى كُلِّ شَئ ٍ قَدِيْرٌ ط 

বাংলা উচ্চারণ: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্ দাহু লা-সারিকা লা-হু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহা ই ওয়া উ মিতু বি ইয়া সি হিল খাইরু ওয়া-হু-ওয়া আ-লা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। 

বাংলা অর্থ :  আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই তিনি এক তার কোন অংশীদার নেই। সমস্ত সৃষ্টি জগৎ এবং সকল প্রশংসা তাঁরই। তিনি জীবন হান করেন আবার তিনিই মৃত্যুর কারণ তার হাতেই সব ভাল কিছু এবং তিনিই সৃষ্টির সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। 

 

পাঁচ.

কালিমায়ে রদ্দে কুফর আরবি :  اللهم انی اعوذبک من ان یشرک بک شیئا واستغفرک ما اعلم به ومالا اعلم به تبت عنه وتبرأت من الکفر والشرک والمعاصی کلها واسلمت وامنت واقول ان لا اله الا الله محمد رسول الله صلی الله علیه وسلم. 

বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাহ ইন্নী আউযুবিকা মিন্ আন্ উশ্রিকা বিকা শাইআওঁ ওয়া আনা আ’লামু বিহী, ওয়া আস্তাগ্ফিরুকা লিমা আ’লামু বিহী, ওয়ামা লা-আ’লামু বিহী, তুব্তু আন্হু ওয়া তাবাররা’তু মিনাল কুফরি ওয়াশ্ শিরকি ওয়াল মায়াছী কুল্লিহা, ওয়া আসলামতু ওয়া আমান্তু ওয়া আক্বুলু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি। 

বাংলা অর্থ :   হে আল্লাহ্! আমি তমার নিকট আকাঙ্ক্ষা করছি যে আমি যেন কাউকে তমার সাথে শরিক না করি। আমি আমার জ্ঞাত ও অজ্ঞাত পাপ হতে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তা হতে তোবা করছি। কুফরী, শিরক ও অন্যান্য সব পাপ হতে দূরে থাকছি। এবং স্বীকার করছি যে, “আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।”

২।নামাজ ঃ আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করে আল্লাহর হুকুম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফজর, যোহর, আসর ,মাগরিব, এশা পড়া। নামাজ না পড়লে এবং নামাজ পড়তে হবে না এমন মনে  করলে  ঈমান থাকে না ।
  নামা‌জের বা‌হি‌রে এবং নামা‌জের ভিত‌রে তের‌টি ফরজ  :~১।শরীর পাক বা প‌বিত্র হওয়া, ২ । কাপড় প‌বিত্র হওয়া  ।৩। নামা‌জের জায়গা প‌বিত্র হওয়া ৪।ছতর ঢাকা বা কাপড় প‌রিধান করা ৫। ওয়াক্ত বা নামা‌জের সময় হওয়া ৬ । কেবলা মুখী হওয়া ;
 ১।" আল্লাহু আকবর" ব‌লে নামাজ শুরু করা ২।দাঁড়াইয়া নামাজ পড়া ৩। সুরা ফা‌তেহা সহ কুরআনের আয়াত (কম প‌ক্ষে ছোট তিন আয়াত ) পড়া ৪।রুকু করা ৫। সেজদা করা ৬। ব‌সে আত্তা‌হিয়াতু পড়া ৭।ডা‌নে ও বা‌মে ছালা‌মের মাধ্য‌মে নামাজ শেষ করা ।ফরজ তালিকা 


তাছাড়া কিছু ওয়া‌জিব ও সুন্নত  র‌য়ে‌ছে । ফরজ নামাজের পরে তসবিহ ঃ


নামাজের সাধারণ কিছু নিয়ম
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কিছু জেনারেল নিয়ম আছে। যা প্রতি ওয়াক্ত বা প্রত্যেক নামাজে এক ও অভিন্ন থাকে।

এমন কিছু নিয়ম নিচে তুলে ধরছি

তাকবিরে তাহরিমা বা আল্লাহু আকবার বলে নামাজে প্রবেশ করবে। এরপর সানা (সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা…) পড়বে।

সানা পাঠের শেষে সুরা ফাতিহা পড়তে হবে। সুরা ফাতিহা পাঠের পর অন্য কোনো সুরা যেমন সুরা ফিল বা সুরা কুরাইশ বা সুরা কাফিরুন বা অন্য যে কোনো সুরা পাঠ করতে হবে।


সুরা ফাতিহা পাঠের পর পবিত্র কুরআন থেকে যে আয়াত বা সুরা তেলাওয়াত করা হয় সেটাকে কিরাত বলা হয়।

আর কিরাতের নিময় হলো মুসল্লির কাছে পবিত্র কুরআনের যে অংশটুকু সব চেয়ে সহজ ও সাবলিল সেখান থেকে কিছু অংশ তেলাওয়াত করবে।

তেলাওয়াতের পরিমাণ ছোট ছোট তিন আয়াত বা বড় এক আয়াত হতে হবে। যেমন সুরা কাওসারের পুরো সুরা মিলে তিন আয়াত।

আবার আয়াতুল কুরসি বড় একটি আয়াত কিন্তু তা ছোট একটি সুরার সমান। এরকম এক আয়াতই তেলাওয়াত করে নিলে হয়ে যাবে।

কিরাত পাঠ করে নিলে আল্লাহু আকবার বলে রুকুতে চলে যাবে। রুকুতে গিয়ে সর্বনিম্ন তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আযিম’ বলবে।

এরপর ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলে রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। এবং ‘রাব্বানা লাকাল হামদ বলবে।

তারপর আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় চলে যাবে। সিজদায় তিনবার ‘সুবাহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ বলবে।

অতপর আল্লাহু আকবার বলে বসবে। বসার পর ‘রাব্বিগ ফিরলি ওয়ারহুমনি… পড়বে।

অতপর আবার সিজদা করে উক্ত তাসবিহ তিনবার পড়বে।

এরপর আল্লাহু আকবার বলে দাঁড়িয়ে যাবে। এবং পূর্বের মতো সুরা ফাতিহা ও কিরাত পড়ে রুকু করে সিজদা করবে।

আত-তাহিয়াতু পড়ার নিয়ম
দুই নাম্বার রাকাতে দ্বিতীয় সিজদার পর না দাঁড়িয়ে বসে যাবে। এবং ‘আত-তাহিয়াতু…’ পড়বে।

নামাজ যদি দুই রাকাত বিশিষ্ট হয় তাহলে ‘আত-তাহিয়াতু… পাঠের পর ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিয়ালা… ও বারিকালা.. এবং আল্লাহুম্মা ইন্নি যালামতু নাফসি…। দোয়াটি বা অন্য দোয়া পাঠ করে সালাম ফিরিয়ে নিবে।

কিন্তু নামাজ যদি চার রাকাত বিশিষ্ট হয় তাহলে কেবল আত-তাহিয়াতু… পাঠ করে দাঁড়িয়ে যাবে।

চার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজ হলে শেষের দু রাকাতে সুরা ফাতিহার পরে অন্য কোনো সুরা বা কিরাত তেওয়াত করতে হয় না।

তখন কেবল সুরা ফাতিহা পাঠের পরই রুকু করে সিজদায় চলে যাবে।


তবে চার রাকাত বিশিষ্ট সুন্নত নামাজ হলে শেষের দু রাকাতেও সুরা ফাতিহার পর অন্য সুরা বা কিরাত মিলাতে হয়।


এটা নামাজের সাধারণ কয়েকটি নিয়ম। যা পাঁচ ওয়াক্তে এবং ফরজ সুন্নত ও নফল সকল প্রকার নামাজের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।


ফজরের নামাজ পড়ার নিয়ম
সুবহে সাদিকের পর ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়। ফজরের নামাজ মোট চার রাকাত।

ফরজ দুই রাকাত আর সুন্নতে মুয়াক্কাদা দুই রাকাত। প্রথমে সুন্নত দু রাকাত পড়তে হয় এরপর ফরজ দু রাকাত।

ফজরের সুন্নত দু – রাকাত পড়ার নিয়ম
ফজরে সুন্নত দু – রাকাত নামাজ আদায়ের আলাদা কোনো নিয়ম নেই। উপরে আলোচিত নিয়মেই পড়তে হবে।

প্রথমে আল্লাহু আকবার বা তাকবিরে তাহরিমা বলে নামাজে প্রবেশ করবে। এরপর সুরা ফাতিহা ও কিরাত পাঠ অন্যান্য বাকি নিয়মে নামাজ পুরো করবে।

সুরা ফাতিহা, কেরাত ও অন্যান্য তাসবিহ সকল কিছু নিম্নস্বরে আদায় করবে।

ফজরের ফরজ নামাজ আদায়ের নিময়
ফরজ নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব। তাই জামাতে ইমাম সাহেবর ইক্তেদা করে নিলে বিশেষ কিছু করতে হয় না।

কেবল ইমাম সাহেবের ইক্তেদা করে তার সাথে সাথে কুরু সিজদা ও তাসবিহগুলো পাঠ করে নিলে নামাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে।

ইমাম সাহেব সুরা ফাতিহা উচ্চস্বরে পাঠ করবেন আর মুক্তাদি মনোযোগের সাথে শ্রবণ করবে।

কিন্তু কেউ যদি কোনো কারণে জামাতে শরীক হতে না পারে তাহলে সে পূর্বে আলোচিত নিয়মে একাএকা পড়ে নিবে।

তবে সুরা ফাতিহা কেরাত উচ্চস্বরে বা নিম্মস্বরে তার ইচ্ছা মতো পড়তে পারেব। সাধারণত নিম্নস্বরে পড়াটাই ভালো।

যুহরের সালাত আদায়ের পদ্ধতি
যুহরের নামাজ দশ রাকাত। প্রথমে সুন্নত চার রাকাত। ফরজ দুই রাকাত। এরপর সুন্নত দুই রাকাত।

ফরজ আদায়ের পূর্বে চার রাকাত সুন্নত আদায় করে নিবে। এই চার রাকাত আদায়ের নিয়ম উপরে আলোচিত হয়েছে।

সুন্নত চার রাকাত আদায়ের পর ফরজ চার রাকাত আদায় করতে হয়। আর ফরজ নামাজ যেহেতু জামাতে পড়া ওয়াজিব তাই ইমাম সাহেবের ইক্তেদা করে নিলেই হবে।

ইমাম সাহেবের সাথে ফরজ চার রাকাত আদায় করে তার সাথে সালাম ফিরিয়ে মাসনুন তাসবিহ তাহলিল পাঠ করবে।

এরপর সুন্নত দুই রাকাত পড়বে। যুহরের ফরজ ও সুন্নত সকল প্রকার নামাজেই সুরা কিরাত নিম্নস্বরে তেলাওয়াত করতে হয়।

আসরের নামাজ পড়ার নিয়ম
আসরের নামাজ আট রাকাত। প্রথমে চার রাকাত সুন্নতে গায়র মুয়াক্কাদা। পরে চার রাকাত ফরজ।

সুন্নত চার রাকাত যেহেতু সুন্নতে গায়র মুয়াক্কাদা তাই তা পড়া ভালো। সওয়াব হবে। কিন্তু না পড়লে গোনাহ হবে না।


এরপর ফরজ চার রাকাত আদায় করবে। ইমাম সাহেবের সাথে জামাতে আদায় করে নিলে কেবল ইমাম সাহেবকে অনুসরণ করবে।

নামাজ পড়ার নিয়ম
আর কোনো কারণে জামাতে শরীক হতে না পারলে উপরে আলোচিত নিয়মে একএকা আদায় করে নিবে।

মাগরিবের সালাত কীভাবে পড়তে হয়
মাগরিবের নামাজ পাঁচ রাকাত। প্রথমে ফরজ তিন রাকাত এরপর সুন্নত দুই রাকাত।

ফরজ নামাজ জামাতে আদায় করে নিলে ইমাম সাহেবকে অনুসরণ করা ও জায়গায় জায়গায় তাসবিহ তাকবির বললেই নামাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে।

আর একএকা পড়লে প্রথমে সুরা কিরাত নিম্নস্বরে পাঠ করে দুই রাকাত পূর্ণ করবে। এরপর প্রথম বৈঠক করে দাঁড়িয়ে যাবে।

তৃতীয় রাকাতে কেবল সুরে ফাতিহা পড়ে রুকু সিজদা করে আত-তাহিয়াতু ও আল্লাহুম্মা সাল্লিয়ালা… বারিকালা… পড়ে সালাম ফিরিয়ে নিবে।

অতপর দু রাকাত সুন্নত আদায় করে নিবে। সুন্নত নামাজের নিময় উপরে আলোচিত হয়েছে। এই সুন্নতেও সুরা কিরাত নিম্নস্বরে পড়বে।

এশার নামাজ পড়ার নিয়মাবলী
আমরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। তার মধ্যে থাকে ফরজ, সুন্নত ও নফল। ফরজ হলো আবশ্যিক নামাজ। যা না পড়লে জবাবদিহি করতে হবে।

তাই কোনো ওয়াক্তের নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্ধারণ করার সময় শুধু ফরজ নামাজের রাকাতকে গণনায় আনা যেতে পারে।

কেননা ফরজ নামাজ ব্যতীত বাকি সকল প্রকার নামাজই নফল নামাজের অন্তর্ভুক্ত।

আমার যে নামাজকে সুন্নত নামে অবহিত সেটা মূলত নফল নামাজেরই একটি স্তর।

নফল অর্থ হলো – অতিরিক্ত। অর্থাৎ ফরজের অতিরিক্ত। কেননা নফল নামাজগুলো আল্লাহ তায়ালা ফরজ করেন নি।

রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – ফরজ নামাজ আদায়ের আগে ও পরে নিজ ইচ্ছায় কিছু নামাজ পড়তেন।

যেহেতু সেই নামাজগুলো ফরজের অতিরিক্ত ছিলো। যা তিনি স্বেচ্ছায় আদায় করতেন তাই সে নামাজকে নফল নামাজ বলা হয়।

আর রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – যে নামাজগুলো নফল হিসাবে আদায় করতে। তা আমাদের জন্য সুন্নত হয়ে গেছে।

কেননা রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – যে আমল করতেন সেটা আমাদের জন্য সুন্নত হিসাবে গণ্য হয়।

সুতরাং বলা যায় এশার নামাজ মূলত চার রাকাত। যেহেতু ফরজ কেবল চার রাকাত।

সুন্নতসহ এশার নামাজের রাকাত সংখ্যা
এশার নামাজের আগে চার রাকাত এবং পরে দুই রাকাত নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদা হিসাবে আদায় করা হয়।

এই দিক বিবেচনায় রেখে বলা যেতে পারে এশার নামাজ দশ রাকাত। ফরজ চার রাকাত এবং সুন্নত ছয় রাকাত।


তবে ফরজের আগে চার এবং পরে দুই রাকাত সুন্নত নামাজের মধ্যেই এশার নামাজের রাকাত সংখ্যা সীমাবদ্ধ নয়।

এই দাশ রাকাত আদায় করার দুই রাকাত দুই রাকাত করে দুই বারে মোট চার রাকাত নামাজ আদায় করা যেতে পারে। যা সুন্নত গায়ব মুয়াক্কাদা হিসাবে গণ্য হবে।

এই চার রাকাত আদায় করার পর দুই রাকাত দুই রাকাত করে নফল নামাজ পড়া যাবে। যার নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই।

এভাবে বিতির নামাজকেও এশার নামাজের সাথে পড়া হয়। যদিও বিতির নামাজ এশার নামাজের অংশ নয় তবুও এশার নামাজের শেষে বিতির পড়ে নেওয়া হয়।

তাহলে এশার নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদাসহ দশ রাকাত। সুন্নতে গায়র মুয়াক্কাদাসহ চৌদ্দ রাকাত। এভাবে বিতিরসহ সতের রাকাত।

নামাজ পড়ার নিয়ম
এশার নামাজ আদায়ের নিয়ম
প্রথমে চার রাকাত সুন্নত পড়তে হয়। এই চার রাকাত সুন্নতে গায়র মুয়াক্কাদা। পড়লে ভালো। আর না পড়লে গোনাহ নেই।

এর পর জামাতের সাথে ফরজ চার রাকাত আদায় করবে। ইমাম সাহের ইক্তেদা করে তাকে অনুসরন করবে।

যদি একা পড়ে তবে সুরা কিরাত মিলিয়ে উপরে আলোচিত নিয়মে আদায় করে নিবে।

ফরজ চার রাকাত আদায়ের পর সুন্নত দুই রাকাত আদায় করে নিবে। এই দু রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

সুন্নতে মুয়াক্কাদা মানে হলো – তাগিদযুক্ত সুন্নত। অর্থাৎ এমন সুন্নত যা আদায় করার জন্য শরিয়ত দৃঢ় তাগিদ দিয়েছে।

আর সুন্নতে গায়র মুয়াক্কাদা মানে হলো – সাধারণ সুন্নত। যা আদায়ের প্রতি শরিয়ত তেমন তাগিদ দেননি। সাধারণভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে এমন।

রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – ফরজ নামাজের আগে বা পরে যে নফল নামাজ খুবই গুরুত্বসহ নিয়মিত পড়তেন।

অন্যদের পড়তে উৎসাহ দিতেন সে সব নফল নামাজকে সুন্নতে মুয়াক্কাদা হিসাবে গণ্য করা হয়।

এভাবে সে নামাজগুলো আদায় করার জন্য শরিয়ত বেশ গুরুত্বারোপ করেনি। তাকে সুন্নতে গায়র মুয়াক্কাদা বলা হয়।

এশার নামজ চাই ফরজ হোক বা সুন্নত যদি একএকা আদায় করা হয় তবে সুরা কিরাত নিম্নস্বরে আদায় করবে।

তবে কেউ চাইলে উচ্চস্বরে সুরা কেরাত পড়তে পারবে। এতে তার নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না।

নামাজ শেষে মাসনুন তাসবিহ তাহলিল ও দোয়া দুরদ করবো। তবে কোনো প্রকার বিদআতে লিপ্ত হওয়া যাবে না।


জানাজার নামাজের দোয়া 

জানাযার নামাজের মধ্যে পঠিত ছানা ও দরূদ নামাজের ছানা ও দরূদের মতোই। কিন্তু জানাযা নামাজে তৃতীয় তাকবিরের পর রয়েছে মৃতব্যক্তি ও জানাযা নামাজ আদায়কারীদের জন্য সুনির্ধারিত কয়েকটি দোয়া। আর তাহলো-

মৃতব্যক্তি (বালেগ) প্রাপ্তবয়স্ক (নারী/পুরুষ) হলে

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া সগিরিনা ওয়া কাবিরিনা ওয়া জাকারিনা ওয়া উংছানা। আল্লাহুম্মা মান আহ্‌ইয়াইতাহু মিন্না ফাআহ্‌য়িহি আ’লাল ইসলাম। ওয়া মাং তাওয়াফ্‌ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ্‌ফাহু আ’লাল ঈমান। আল্লাহুম্মা লা তাহরিমনা আঝরাহ ওয়া লা তুদিল্লানা বাআ’দা।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি। 



৩। রোজা ঃরমজান মাসে সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নামই রোজা । 
৪।যাকাত ঃ প্রতি বছর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ এবং সাড়ে 52 তোলা রুপার মূল্যের সমান অর্থ জীবন নির্বাহের পর উদ্বৃত্ত থাকলে তার আড়াই শতাংশ হারে  দরিদ্র মানুষকে  দান করার নামই যাকাত ।
   "কোন ব্যক্তির ওপর ইবাদত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত থাকে। যাকাত ফরজ হওয়ার জন্যও কিছু শর্ত আছে। এগুলোর মধ্যে কিছু শর্ত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার যাকাত আর্থিক ইবাদত হওয়ায় সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু শর্তও আছে। শর্তগুলো হলো-মুসলিম হওয়া : যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো মুসলিম হওয়া। যাকাত মুসলিমদের ওপর এক প্রকারের ইবাদত বিধায় তা অমুসলিমদের জন্য ফরজ হওয়ার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক।বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া : শাফি’ঈ, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাব মতে, সম্পদশালী শিশুর ওপর যাকাত ফরজ হবে। তার সম্পদ হতে তার ওয়ালী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক যাকাত আদায় করবেন। হানাফী মাযহাব মতে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে শিশুর সম্পদে যাকাত নেই। শিশুর সম্পদে যাকাত ফরজ না হওয়ার পক্ষে তাদের দলিল হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন প্রকারের মানুষের ওপর হতে তাকলীফের কলম তুলে নেয়া হয়েছে- পাগল, যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসে; ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয় এবং শিশু যতক্ষণ না সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়’  (জামে আত তিরমিযী)। তাছাড়া যাকাত এক প্রকারের ইবাদত বিধায় শিশুর ওপর তা ফরজ হবে না, যেমন সালাত ও রোযা শিশুর ওপর ফরজ হয় না (আল-কাসানী)। তবে অধিকাংশ আলেমদের মতে শিশুদের যাকাত পরিশোধ করাই অধিকতর দলিলসম্মত।
  বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া : হানাফী মাযহাব মতে, যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার শর্ত রয়েছে। তাই পাগলের ওপর যাকাত ফরজ নয়। যুক্তি হিসেবে তাঁরা তিন প্রকারের ব্যক্তির ওপর তাখলীফের কলম তুলে নেয়ার হাদীসটি  উল্লেখ করেন। অন্যান্য মাযহাব মতে, পাগলের ওপর যাকাত ফরজ হবে, তার পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক যাকাত আদায় করবেন।
    স্বাধীন ব্যক্তি হওয়া : যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের মালিকের স্বাধীন হওয়া অন্যতম শর্ত। এ কারণে দাসের ওপর যাকাত ফরজ নয়। বস্তুতপক্ষে দাস কোনো সম্পদের মালিক নয়, তার সব সম্পদের মালিক তার মনিব। তাই তার ওপর যাকাত ফরজ হওয়ার কোন প্রশ্ন নেই।নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা : যাকাত ফরজ হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা। শরীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদকে নিসাব বলে। যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত ফরজ হয়। এ সম্পদগুলো হলো নগদ বা ব্যবসায় বিনিয়োগকৃত টাকা, স্বর্ণ, রৌপ্য, শস্য ও প্রাণী।
    সম্পদের ওপর পূর্ণ মালিকানা : যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের ওপর মালিকানা ও পূর্ণাঙ্গ দখল থাকতে হবে এবং সম্পদ ব্যবহারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে, অন্যথায় যাকাত ফরজ হবে না। যেমন জনকল্যাণে ওয়াকফকৃত সম্পদে যাকাত নেই। তবে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য ওয়াকফ করা হলে তার যাকাত দিতে হবে।
যৌথ মালিকানাভুক্ত সম্পত্তির যাকাত : কোন সম্পদের দুই বা ততোধিক মালিক থাকলে প্রত্যেকে নিজ নিজ অংশের যাকাত দেবেন। যদি প্রত্যেক মালিকের অংশ আলাদাভাবে নিসাব পরিমাণ না হয় তাহলে কাউকে যাকাত দিতে হবে না। যদি কারো অংশ নিসাব পরিমাণ হয় তবে তাকে যাকাত দিতে হবে।
হারাম সম্পদের যাকাত : চুরি, ডাকাত, সুদ, ঘুষ, ছিনতাই, রাহাজানি, অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদি অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ হারাম বা অবৈধ সম্পদ বলে গণ্য। হারাম পন্থায় উপার্জনকারী ব্যক্তি ওই সম্পদের মালিক নয়। অতএব, তা খরচের অধিকারও তার নেই। যাকাত প্রদানও এক ধরনের খরচ।
   সম্পদ বর্ধনযোগ্য হওয়া : যাকাত ফরজ হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দরিদ্রকে সহযোগিতা এবং তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা। কিন্তু নিশ্চয়ই আল্লাহ চান না যে, যাকাত আদায় করে ধনী ব্যক্তি দরিদ্র হয়ে যাক। সম্পদ যদি বর্ধনশীল না হয় এবং তা হতে বছরের পর বছর যাকাত আদায় করা হতে থাকে, তাহলে ধনী ব্যক্তি এক সময় দরিদ্র্য হয়ে যাবে। তাই যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া অপরিহার্য। 
  সম্পদ একবছর অধিকারে থাকা : কোন সম্পদ যদি এক বছরের কম সময়ে হাতে থাকে, তবে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে না। এ শর্তটি নগদ অর্থ, স্বর্ণ-রৌপ্য, চতুষ্পদ জন্তু ও ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একবছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কোন সম্পদে যাকাত নেই’। (সুনানে আবু দাউদ)  
     সম্পদ মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া: হানাফী মাযহাবের আলিমগণ যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য অতিরিক্ত একটি শর্তারোপ করেন, সেটি হলো যাকাতযোগ্য সম্পদ মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ হয় না। যে ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ নেই তাকে ধনী বলা যায় না। আর যাকাত ফরজ করা হয়েছে ধনীদের ওপর। রাসূলুল্লাহ (সা.) যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে মু’আয (রা.)কে বলেছিলেন, ‘এটি ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতে হবে।’ (সহীহ আল বুখারী)    
 ঋণমুক্ত হওয়া : ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির সম্পদের প্রথম হকদার হলো পাওনাদার। তাই প্রথমে ঋণ আদায় করতে হবে। অবশিষ্ট সম্পদ নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কারো ওপর ঋণ থাকলে সে যেন প্রথমে তা শোধ করে, তারপর বাকি সম্পদের যাকাত আদায় করবে।’ (মুয়াত্তা)   
  মৃত ব্যক্তির যাকাত : কোনো ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরজ হয়েছে কিন্তু তিনি তা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাহলে তার রেখে যাওয়া সম্পদ হতে ওয়ারিশগণ বা সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক যাকাত আদায় করবেন।  
     বহির্বিশ্বে রক্ষিত সম্পদের যাকাত : কারো সম্পদ যদি বিদেশের ব্যাংকে থাকে কিংবা কেউ যদি বিদেশে ব্যবসা করেন এবং ওই সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ হয়, তবে তাকে যাকাত আদায় করতে হবে। বিদেশে শরীয়াহ নির্ধারিত খাতে যাকাত বণ্টন করার সুযোগ থাকলে তিনি সেখানে বণ্টন করতে পারবেন, অন্যথায় নিজ দেশে যাকাত আদায় করবেন। 
  কয়েদি বা সাজাপ্রাপ্ত আসামীর যাকাত : কারাদণ্ড বা বন্দিদশা যাকাত রহিত করে না। কারাবন্দী সে হাজতি হোক বা সাজাপ্রাপ্ত হোক নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাকে যাকাত দিতে হবে। তার পক্ষ হতে তার পরিবারের সদস্য বা তার সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক যাকাত আদায় করবেন। যদি তা না হয় মুক্তিলাভের পর পূর্বের বছরগুলোর যাকাত তাকে হিসাব করে আদায় করতে হবে।   মুসাফিরের যাকাত : সফরের কারণেও যাকাতের বিধান রহিত হয় না। মুসাফির ব্যক্তি (সফরকারী ব্যক্তি) যদি নিজ দেশে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তাহলে ওই সম্পদের যাকাত দিতে হবে। এটা সত্য যে, সম্পদশালী মুসাফিরও যদি বিদেশে বিপদগ্রস্ত হন তাহলে তিনি যাকাত গ্রহণ করতে পারেন। তাই বলে এ বিধানের বলে দেশে রক্ষিত সম্পদের ওপর যাকাতের আবশ্যকতা রহিত হয় না।তথ্যসূত্র : সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট "
৫। হজ্ব ঃ যাকাতের শর্ত পূরণ এবং পারিবারিক খরচ নির্বাহ এর পর কারো হাতে মক্কায় গমনের যাতায়াত খরচ থাকলে তার জন্য হজ্ব  করা ফরজ। 
হজ্বের ফরজ ৩টি

১। ইহরাম বাধা ২। উ’কুফে আ’রাফা (আরাফাতের ময়দানে অবস্থান) ৩। তাওয়াফুয্ যিয়ারাত

হজ্জের ওয়াজিব ৬টি

(১) ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দ্বয়ের মাঝে ৭ বার সায়ী করা।
(২) অকুফে মুযদালিফায় (৯ই জিলহজ্জ) অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সুর্যদয় পর্যন্ত একমুহুর্তের জন্য
হলেও অবস্থান করা।
(৩) মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিপে করা।
(৪) ‘হজ্জে তামাত্তু’ ও ‘কি্বরান’ কারীগণ ‘হজ্জ’ সমাপনের জন্য দমে শোকর করা।
(৫) এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা।
(৬) মক্কার বাইরের লোকদের জন্য তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কা থেকে বিদায়কালীন তাওয়াফ করা।
এছাড়া আর যে সমস্ত আমল রয়েছে সব সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব।

ওমরাহর ফরজ, ওয়াজিব

দুইটি ফরজ: (১) ইহরাম পরিধান করা (২) তাওয়াফ
দুইটি ওয়াজিব: (১) সাফা ও মারওয়া মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে সাতবার সায়ী করা (২) মাথার চুল
মুন্ডানো বা ছাটা।

তালবিয়া

”লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক, লাব্বাঈক, লা-শারীকা-লাকা লাব্বাঈক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুল্ক, লা শারীকালাক।”
অর্থ: আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার।
আপনার কোন অংশীদার নেই।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ

(১) সেলাইযুক্ত যে কোন কাপড় বা জুতা ব্যবহার, এক্ষেত্রে স্পঞ্জ সেন্ডেলের ব্যবহার করা।
(২) মস্তক ও মুখমন্ডল (ইহরামের কাপড়সহ যে কোন কাপড় দ্বারা) ঢাকা,
(৩) পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা।
(৪) চুলকাটা বা ছিড়ে ফেলা,
(৫) নখকাটা,
(৬) ঘ্রানযুক্ত তৈল বা আতর লাগানো।
(৭) স্ত্রীর সঙ্গে সংগম করা।
(৮) যৌন উত্তেজনামূলক কোন আচরণ বা কোন কথা বলা।
(৯) শিকার করা।
(১০) ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ করা।
(১১) চুল দাড়িতে চিরুনী বা আঙ্গুলী চালনা করা, যাতে ছেড়ার আশংকা থাকে।
(১২) শরীরে সাবান লাগানো।
(১৩) উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোন জীবজন্তু হত্যা করা বা মারা।
(১৪) কোন গুনাহের কাজ করা, ইত্যাদি।

হজ্জের প্রকার ও নিয়তসমূহ

প্রথম প্রকার হজ্জে ইফরাদ

বর্ণনা: ওমরাহ্ ব্যতিত শুধু হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধা এবং হজ্জের সাথে ওমরাহকে না মিলানো। (বদলী হজ্জের জন্যও এই হজ্জ)।
নিয়্যাত: আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াসছির হুলিওয়াতা কাব্বালহুমিনি্ন। (বাংলা নিয়ত- আল্লাহ আমি ইফরাদ হজ্জের উদ্দেশ্যে আপনার সন্তুষ্টির জন্য ইহরাম বাধলাম। তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন)।

দ্বিতীয় প্রকার হজ্জে কি্বরান

বর্ণনা: একত্রে একই স্থান থেকে হজ্জ ও ওমরার নিয়্যাত করে হজ্জের সাথে ওমরাহকে মিলানো এবং একই ইহ্রামে উভয়টি আদায় করা।
নিয়্যাত: আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল উ’মরাতা ফায়াচ্ছির লী-ওয়াতাক্াব্বাল মিন্নী। বাংলা নিয়ত- হে আল্লাহ আমি আপনার উদ্দেশ্যে হজ্জে কি্বরানের জন্য ইহরাম বাধলাম তা সহজ করে দিন ও কবুল করে নিন।

তৃতীয় প্রকার হজ্জে তামাত্তু

বর্ণনা: একই সফরে পৃথক পৃথক ভাবে ‘ইহরাম’ পরিধান করে ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ আদায় করা। প্রথম ইহ্রামে ওমরাহর নিয়্যাত করে তা পালন শেষে চুল কেটে ‘ইহরাম’ খুলে হালাল হয়ে দ্বিতীয় বার নতুন করে হজ্জের নিয়্যাতে ৮ই জিলহজ্জ ‘মক্ক শরীফ’ থেকে হজ্জের জন্য ইহরাম বাধা। তামাত্তু করার ইচ্ছা থাকলে প্রথমে ওমরার নিয়্যাত করে এহরাম বাঁধুন।

শুধু ওমরাহর নিয়্যাত

আল্লাহুমা ইন্নী উরীদুল উম’রাতা ফায়াচ্ছির লী-ওয়াতাক্াব্বাল মিন্নী। বাংলা নিয়ত- হে আল্লাহ আমি ওমরাহ্ পালনের জন্য ইহরাম বাধলাম তা সহজ করে দিন এবং কবুল করে নিন।

শুধু হজ্জের নিয়্যাত

আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াচ্ছিরহু-লী অ-তাকাব্বালহু মিন্নী। বাংলা নিয়ত- হে আল্লাহ আমি পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য ইহরাম বেধে নিয়ত করলাম তা সহজ করে দিন এবং কবুল করে নিন।

তাওয়াফের বিবরণ

হাজীদের সর্বপ্রথম কাজই হলো (তামাত্তু ও ক্বেরান কারীগণ) নিজের মালছামানগুছিয়ে রেখে পাকপবিত্র হয়ে মোটেই দেরী না করে ‘হারাম শরীফে’ হাজিরা দেওয়া এবং ‘তাওয়াফ’ করা। ওমরাহ এবং হজ্জের তাওয়াফ ব্যাতিত নফল তাওয়াফ ও করা যায়। যেমন: রাসূল (দঃ), সাহাবা-আওলিয়া, আহ্লে বাইত, মা-বাবা, পীর-উস্তাদ ও অন্যান্য মুরুব্বী বা সন্তানদের স্মরনে বা তাঁদের নামে তাওয়াফ করা।

তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ

(১) শরীর পাক-সাফ রাখা, ওজু করা। মহিলাদের হায়েজ নেফাছ অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েজ নাই।
(২) ছতর ঢাকা। অর্থাৎ যেটুকু ঢাকা প্রত্যেক পুরুষ-নারীর জন্য ফরজ।
(৩) ‘হাতীমে কা’বার’ বাইরে থেকে ‘তাওয়াফ’ করা।
(৪) পায়ে হেঁটে ‘তাওয়াফ’ করা। অম ব্যক্তি খাটিয়ার মাধ্যমে ‘তাওয়াফ’ করতে পারেন।
(৫) ‘হাজ্রে আস্ওয়াদ’ থেকে শুরু করে ডানদিক দিয়ে ‘তাওয়াফ’ শুরু করা।
(৬) এক নাগাড়ে বিরতিহীন ভাবে ‘সাতবার চক্কর’ দিয়ে ‘তাওয়াফ’ পূর্ণ করা।
(৭) ‘সাত চক্করে’ এক ‘তাওয়াফ’, এটা পূর্ণ হলেই ‘তাওয়াফের’ নামাজ পড়া।

তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী

(১) ‘তাওয়াফে’র শুরুতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এর দিকে মুখ করা।
(২) সম্ভব হলে ‘হাজ্রে আস্ওয়াদ’ চুম্বন করা। নতুবা হাত দ্বারা দূর থেকে ইশারা করা, এবং মুখে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আক্বার ওয়ালিল্লাহিল হ্ামদ’ বলা।
(৩) ‘হা্জ্রে অস্ওয়াদ’ বরাবর দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরিমা’র ন্যায় উভয় হাত সিনা পর্যন্ত উঠান।
(৪) যে ‘তাওয়াফে’র পরে ‘সাঈ’ আছে তাতে ‘এযতেবা’ করা। অর্থাৎ ইহরামের চাদরের (উপরের অংশের) দুই মাথা ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর ফেলে দেওয়া।
(৫) ‘সাঈ’ যুক্ত ‘তাওয়াফে’র প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা। অথর্াৎ বীরের মত হেলে দুলে জোর ক্বদমে (একের পর এক পা ফেলে) চলা।
(৬) বাকী চার চক্কর সাধারণ গতিতে (ধীরে ধীরে) সম্পন্ন করা।
(৭) প্রত্যেক চক্কর তাওয়াফ শেষ করে এবং শেষ চক্করেরও পরে ‘হাজ্রে অস্ওয়াদ’কে চুম্বন করা।
সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারা করে বিসমিল্লাহে আল্লাহ আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ্”দোয়াটি পাঠ করা এবং ৩ নং নিয়মের ন্যায় দাড়িয়ে ইশারা করে ‘তাওয়াফ’ শেষ করা।

তাওয়াফের নিয়্যাত

আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদু তাওয়াফা বাইতিকাল হারাম ফায়াচ্ছিরহু-লী, ওয়া তাক্বাব্বাল-হু-মিন্নী, সাবাআ’তা আশ্ওয়াতি্বন লিল্লাহি তায়া’লা। বাংলায় নিয়ত- হে আল্লাহ আমি তাওয়াফ পালনের জন্য নিয়ত করলাম।

সায়ীর নিয়ম

‘হজ্জ ও ওমরাহ’ ছাড়া নফল ‘তাওয়াফে’র কোন সায়ী নাই। কারো নামে ওমরাহ করতে হলেও সায়ী করতে হবে। সায়ী অর্থ দৌড়ানো। এটা ‘ছাফা’ পাহাড় থেকে প্রথমে শুরু করতে হবে। ছাফা থেকে মারওয়া।মারওয়া থেকে ছাফায়। এভাবে সাতবার সায়ীর সময় প্রথম তিন চক্কর সবুজ বাতির মাঝের অংশটুকু দৌড়ে দৌড়ে হেলে দুলে যাওয়া সুন্নাত (পুরুষদের জন্য)। পরের চার চক্কর সাধারণ গতিতে সম্পন্ন করতে হবে।

সায়ীর সহজ দোয়া

সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়া লা-হাওলা, ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আ’লিয়্যিল আ’যীম, রাবি্বগফির ওয়ারহাম ওয়াআনতাল আ-আজ্জুল আকরাম।

সায়ীর কুরআনী দোয়া

‘ইন্নাছ্ ছাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন্ শাআ’ইরিল্লাহ্ ফামান হাজ্জাল বাইতা আও-ই’ তামারা ফালা জুনাহা আ’লাইহি আইয়াত্ত্বাওয়াফা বিহিমা ওমান তাত্বাওয়াআ খাইরান ফা-ইন্নাল্লাহা শাকিরুণ আ’লীম।” উপরোক্ত দুই দোয়া সাতবার চক্করের সময় হাটতে চলতে পড়তে হবে। পরেরটি না পারলে উপরেরটিই যথেষ্ট হবে।



১৬ নভেম্বর ২০২০

ইসলামী অর্থনৈতিক লেনদেনে প্রতারণা

     ইসলামী অর্থনৈতিক  লেনদেনে সুদ বর্জন করা অপরিহার্য। মহান আল্লাহ সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন এবং ব্যবসায়কে বৈধ করেছেন। আল্লাহ বলেন :” অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”(সুরা আল-বাকারার ২৭৫) 

০৪ নভেম্বর ২০২০

ঈমান কি?

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বীকার করা ,স্বীকৃতি দেওয়া, দৃঢ় বিশ্বাস করা। ইসলাম ধর্মে ঈমানের অর্থ হল, না দেখে আল্লাহ ও আল্লাহর ঘো‌ষিত  বিষয়ে  মুখে স্বীকার ক‌রে, অন্তরে বিশ্বাস করা ও কাজের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ । 

আল কুরআনের সুরা বাক্বারাহ এর ২ হ‌তে ৪ নম্বর আয়াতে বিষয়গুলি বর্ণিত আছে। বলা হয়েছে-
"২। এই সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নাই ,মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত। 
৩।যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। ৪।আর যারা ঈমান আনে তাতে যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। "

ঈমানের সাতটি বিষয় হচ্ছে -
১) এক আল্লাহকে বিশ্বাস করা। 
২)আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস করা। 
৩) আসমানী কিতাব সমূহের প্র‌তি বিশ্বাস করা ।
৪) সকল নবী রাসূলগণের প্র‌তি বিশ্বাস করা ।
৫) তক্বদীর বা ভা‌গ্যের ভালো-মন্দ  যাতে আল্লাহর ক্ষমতা র‌য়ে‌ছে তাতে বিশ্বাস করা ।
৬) আখিরাতে বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস করা ।
৭) মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হওয়ার প্রতি বিশ্বাস করা। 

ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে। সেগুলো হলো :-
১)কালেমা (বিশ্বাস ) 
২)নামাজ (প্রার্থনা )
৩)রোজা ( বিরত থাকা )
৪)যাকাত (দান)
৫) হজ্ব (কাবা ঘর তাওয়াফ)। 
 
আরও জানতে নিচের লিঙ্ক এ ক্লিক করুন >

২৮ অক্টোবর ২০২০

মাজহাবি না সালাফি কোন‌টি ঠিক ?


সালাফী-মাজহাবী যেখানে একমত

মাজহাবশব্দের অর্থ হলো পথ বা মত। ইসলামী আইনের পরিভাষায়, মাজহাব (School of Thought) হলো এমন কিছু উসুল” (Set of Principles) যা অনুসরণ করে কোনও কাজের শারঈবিধান (অর্থাৎ হালাল, হারাম, ফরজ, নফল ইত্যাদি) নির্ধারণ করা হয় ।  ইসলামের ইতিহাসে ২০টিরও বেশী মাজহাব এর সন্ধান পাওয়া যায়। তার মধ্যে ৪ টি মাজহাব প্রসিদ্ধ। এগুলো হলো ইমাম আবু হানিফার (মৃত্যু  ১৪৮ হিজরী) দেয়া উসুল অনুসারে হানাফী মাজহাব, ইমাম মালিকের (মৃত্যু ১৭৯ হিজরী) দেয়া উসুল অনুসারে মালিকি মাজহাব, ইমাম শাফেঈর (মৃত্যু ২০৪ হিজরী) দেয়া উসুল অনুসারে শাফেঈমাজহাব ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (মৃত্যু ২৪১ হিজরী)  এর উসুল অনুসারে হাম্বালী মাজহাব। যারা এই মাজহাবগুলোর অনুসরণ করেন তাদেরকে মাজহাবীবলা হয়।

সালাফশব্দের অর্থ হলো পূর্বসূরী। ইসলামী পরিভাষায় সালাফবলতে ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের মানুষকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ, সাহাবারা, তাঁদের পরের প্রজন্ম (তাবিঈন) ও তাঁদের পরের প্রজন্মের (তাবাআত-তাবিঈন) সবাই হলেন সালাফ । বর্তমান সময়ে যে সব ইমাম প্রচলিত চার মাজহাবের একটিকে নির্দিষ্টভাবে অনুসরণ না করে, চার মাজহাবের মতামত ও অন্যান্য প্রখ্যাত ইমামের মতামতগুলোকে তুলনা করে যে মতামতটিকে কুরআন  ও সহীহ হাদিসের সাথে সবচেয়ে বেশী সংগতীপূর্ণ মনে করে থাকেন সেটাকে অনুসরণ করেন তাঁরা নিজেদেরকে সালাফীহিসাবে পরিচয় দেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন তাঁরা সালাফদের পদ্ধতিতে ইসলাম পালন করেন।

এক মাজহাব থেকে অন্য মাজহাব স্বকীয় হয় তার উসুল (“Set of Principles”) এর কারণে। আবার, “মাজহাবথেকে সালাফী তত্ত্বস্বকীয়ও হয় তার উসুল (“Set of Principles”) এর কারণে।  মাজহাবী/সালাফীদের মধ্যে আজকে আমরা যতই বিরোধীতা দেখি না কেন, উসুল (“Set of Principles”) সংক্রান্ত নিচের বিষয়গুলোতে দুই পক্ষই কিন্তু একমত:

১।      সর্বোচ্চ মর্যাদা পাবে কুরআন ও সহীহ হাদিস (এদেরকে একত্রে আন-নাস বলে)

২ ।   এর পর মর্যাদা পাবে ইজমা’ (সাহাবা বা কোনও যুগের সকল আলেমের ঐক্যমত)

৩ ।  উপরের তথ্যগুলির সাহায্যে কোনো বিষয়ের ফিকহ (Islamic Ruling / Understanding) নির্ধারণ না করা গেলে কিয়াস (Analogy) ব্যবহার করা যাবে।

  ৪ ।  কুরআন ও হাদিসকে সেভাবে বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবী ও সালাফরা বুঝেছিলেন। কারণ, তাঁরা যেহেতু রাসূলুল্লাহ(সা) এর সরাসরি ছাত্র ছিলেন তাই তাঁদের চাইতে ভালো আর কেউ এই বিষয়গুলো বুঝতে পারবে না।  (এই চতুর্থ পয়েন্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা মনের মধ্যে গেঁথে ফেলুন, এই ব্যাপারটা বারে বারে আসবে।)

সালাফী-মাজহাবী যেখানে দ্বিমত

মাজহাব এর সাথে সালাফি তত্ত্বের একটা অন্যতম পার্থক্য হলো মাজহাবীদের কাছে তাদের ইমামের মতামতও একটি দলীল  । এর যুক্তি হলো যেহেতু ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফারা তাবেঈদের সরাসরি ছাত্র ছিলেন, কাজেই তাঁরা যদি কোনো মতামত দিয়ে থাকেন সেটা অবশ্যই তাবেঈও সাহাবাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কাজেই তাঁদের মতের সমর্থনে শুদ্ধ হাদিস না পাওয়া গেলেও খুব সহজেই তাদের মতামত বাদ দেয়া যাবে না । বরং, তাঁদের মতামতকে বাদ দেয়ার জন্য সেই মত-বিরোধী শক্ত কোনো হাদিস বা অন্য প্রমাণ থাকতে হবে। অন্যদিকে, সালাফীরা সাধারনত শুদ্ধ সনদ (বর্ণনাকারীর ধারা) ছাড়া কোনো হাদিস গ্রহণ করে না।

মাজহাব এর সাথে সালাফি তত্ত্বের আরেকটা পার্থক্য হলো প্রত্যেক মাজহাবের পক্ষেই গত ১১০০ বছরের হাজার হাজার ইমাম আছেন। শরীয়তের কোনও আদেশ পালনের ক্ষেত্রে কোনও মাজহাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামের ঐক্যমতকে ঐ মাজহাবের ফিকহ (Understanding) বলা হয়। অন্যদিকে সালাফী মতবাদ শুরু হয়েছে মাত্র দুই-আড়াইশ বছর আগে। ফলে, সালাফী মতবাদের ইমামদের মধ্যে সেরকমভাবে কোনো ঐক্যমত এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি । যেমন শাইখুল হাদিস নাসিরুদ্দীন আলবানী মনে করেন একজন মুসলিম নিজেকে সালাফীপরিচয় দিতে পারবে, কিন্তু শেইখ উথাইমিন মনে করেন একজন মুসলিম নিজেকে মুসলিমহিসাবেই পরিচয় দিবে । কাজেই, একজন সালাফী ঐতিহাসিক ইমাম-গোষ্ঠির ফিকহ (Understanding) অনুসরণ করে না, সে আধুনিক সময়ের একজন ব্যক্তি-ইমামের ফিকহ অনুসরণ করে। তাই আপনি একজন সালাফীকে বলতে শুনবেন – “আমি নাসিরুদ্দীন আলবানির বই/ফিকহ অনুসারে নামাজ পড়িঅন্যদিকে একজন মাজহাবী হয়তো বলবে – “আমি মালিকি মাজহাব অনুসারে নামাজ পড়ি

 সালাফীদের যুক্তি ও প্রতি-উত্তর

লেখার এই অংশে আমরা সালাফীদের বিভিন্ন যুক্তি  সম্পর্কে জানবো কেন তাঁরা মনে করেন মাজহাব বাদ দিয়ে কুরআন আর সহীহ হাদিসের অনুসরণ করতে হবে? একই সাথে আমি সালাফীদের যুক্তিগুলোকে খন্ডন করারও চেষ্টা করব। যুক্তি-খন্ডন করতে যেয়ে আমি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মালিকি মাজহাবের উসুল (“Set of Principles”) কে উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করব। কারণ, যুক্তি-খন্ডনের কথাগুলো আমি মূলত: শেইখ হামযা ইউসুফের লেকচার থেকে নিয়েছি যিনি একজন মালিকি ইমাম।

সালাফী যুক্তি ১: সকল বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে আমাদের কুরআন ও সহীহ হাদিস মানতে হবে। কিন্তু, প্রচলিত মাজহাবগুলোতে আমরা এমন অনেক বিধান দেখি, যেগুলো সহীহ হাদিস বিরোধী। কাজেই মাজহাবের অনুসরণ করা যাবে না।

যুক্তি-খন্ডন: এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের সব ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মানতে হবে। কিন্তু এমন অনেক সুন্নাহ আছে, যা হাদিস আকারে লিপিবদ্ধ হয়নি কিন্তু মদীনার সাহাবাদের মধ্যে সেই সুন্নাহগুলোর প্রচলন ছিল। ইমাম মালিক এই ক্ষেত্রে সহীহ হাদিসের বিপরীতে সাহাবাদের আমলকে প্রাধান্য দিয়েছেন।  যেমন শুক্রবারে নফল রোযা রাখা যাবে না, এটা সহীহ হাদিস। কিন্তু, ইমাম মালিক মদীনায় তাবেঈনদের মধ্যে শুক্রবারে নফল রোযা রাখার প্রচলন দেখেছেন। এই তাবেঈনরা সরাসরি সাহাবাদের থেকেই এই আমল শিখেছেন। ইমাম মালিকের মতে, হয়তো পরবর্তীতে শুক্রবারে নফল রোজা রাখা যাবে নাহাদিসের বিপরীতে শুক্রবারে নফল রোজা রাখা উচিতএর হুকুম রাসূলুল্লাহ(সা) দিয়েছিলেন, ফলে আগের হুকুমটি বাতিল (Abrogate) হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ঐ হুকুমটি হাদিস আকারে আমাদের কাছে পৌঁছায়নি, পৌঁছেছে সাহাবাদের আমলের (Practise) মাধ্যমে।  কাজেই, মালিকি মাজহাব অনুসারে শুক্রবারে নফল রোযা রাখা সুন্নাত, যদিও এর বিপরীতে সহিহ হাদিস আছে ! সুতরাং,  চতুর্থ পয়েন্টের  কুরআন ও হাদিসকে সেভাবে বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবী ও সালাফরা বুঝেছিলেন” – মাজহাবীরা মনে করে এই মূলনীতি সালাফীরা যতটা অনুসরণ করে, তারা তার চেয়েও বেশী অনুসরন করে।

সালাফী যুক্তি ২: মাজহাবগুলো যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন ইমাম বুখারী (মৃত্যু ২৫৬ হিজরী) ও ইমাম মুসলিমের (মৃত্যু ২৬১ হিজরী) মতো সহীহ হাদিস গ্রন্থগুলো লেখা হয়নি। ফলে, মাজহাবের ইমামরা অনেক সহীহ হাদিস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। অথবা, কোনো হাদিসকে উনারা হয়তো দুর্বল বলে বাদ দিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ হাদিসটি অন্য কোনো সনদে সহীহ ছিল, যা জানা গিয়েছিলো পরবর্তী সময়ে। এই কারণে মাজহাবগুলোতে এমন অনেক মতামত দেখা যায়, যা সহীহ হাদিস বিরোধী।

যুক্তি-খন্ডন: এই যুক্তিটা বিভিন্ন কারণে [৪] দুর্বল। যেমন

প্রথমত:  হাদিস সংকলন শুরু হয়েছিলো রাসূলুল্লাহ () এর জীবিতকালেই। একথা সুপ্রসিদ্ধ যে, আবু হুরাইরা(রা), ইবনে আব্বাস(রা), আমর ইবনুল আস(রা) সহ প্রচুর সাহাবী লিখিত আকারে হাদিস সংরক্ষণ করেছিলেন [১৫]। এই সব কিতাবের হাদিসগুলি পরবর্তী যুগের হাদিসগ্রন্থগুলোর (যেমন বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ইত্যাদি) মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে। তাই, মদীনার সাহাবারা-তাবেঈনরা বুখারী-মুসলিমের হাদিসগুলো জানতেন না, এ কথা অমূলক।

দ্বিতীয়ত: বেশীরভাগ হাদিসের উৎস মূলত মদীনা শহর, আর ইমাম মালিক তাঁর সারাটা জীবন মদীনায় কাটিয়েছেন তাবেঈনদের কাছে পড়াশুনা করে। ইমাম মালিক সরাসরি ৬০০ তাবেঈনের কাছ থেকে হাদিস ও ফিকহ শিখেছেন, আর এই ৬০০ তাবেঈন শিখেছেন সরাসরি সাহাবীদের কাছ থেকে, মদীনায় তখন ১০ হাজার সাহাবী ছিল।  ইমাম মালিক হাদিস শিখেছেন ঐ যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিশাম ইবনে উরওয়া, ইবনে শিহাব আল-যুহরীর মতো বাঘা মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে আহকাম (হালাল-হারাম) সংক্রান্ত হাদিসের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশী নয়। কাজেই, ইমাম মালিক কোনো বিষয়ের আহকাম সংক্রান্ত সহীহ হাদিসগুলো জানতেন না এই সম্ভাবনা খুবই কম।

তৃতীয়ত: যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে ইমাম মালিক ১০%-১৫% সহীহ হাদিস জানতেন না, তবুও আপনি বলতে পারবেন না যে, মালিকি মাজহাব সহীহ হাদিস এর উপর আমল করে না। এর কারণ হলো, আমরা আগেই বলেছি মাজহাববলতে বুঝায়উসুলবা Set of Principles, মাজহাব বলতে কোনো নির্দিষ্ট শারঈবিধানকে বুঝায় না। ইমাম মালিকের মৃত্যুর পর থেকে যখনই নতুন কোনো হাদিস পাওয়া গেছে তখনই মালিকি মাজহাবের আলেমরা সেই নতুন হাদিসের আলোকে তাঁদের বিধানে পরিবর্তন এনেছেন, কিন্তু ইমাম মালিকের দেয়া উসুলঅনুসরণ করেছেন। একই ব্যাপার অন্য মাজহাবগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন ইমাম আবু হানিফার ছাত্র শাইবানী (মৃত্যু ১৮৯ হিজরী) বহু ক্ষেত্রে নতুন হাদিসের আলোকে ইমাম আবু হানিফার মতের বিরোধী মতামত দিয়েছেন। কিন্তু, তারপরেও ইমাম শাইবানী হানাফী মাজহাবের অনুসারী, কারণ তিনি ইমাম আবু হানিফার উসুলঅনুসরণ করেছেন। গত ১১০০ বছর ধরে বিভিন্ন মাজহাবের আলেমরা এভাবে করেই নতুন পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাঁদের মতামতে পরিবর্তন এনেছেন।

উল্লেখ্য যে, হানাফী মাজহাবের উসুল অনেক অংশেই নেয়া হয়েছে কুফার সাহাবাদের কাছ থেকে [২৮]। আলী(রা) তাঁর খিলাফত মদীনা থেকে কুফায় সরিয়ে নেয়ার পর, বহু সংখ্যক সাহাবী কুফায় চলে আসেন। আলী (রা) সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে কুফার কাজী নিযুক্ত করেন। আর কুফার সাহাবীদের উসুলই হানাফী মাজহাবের উসুল।

সালাফী যুক্তি ৩: মাজহাবগুলি তাদের ইমামের মতামত এর বিপরীতে সহীহ হাদিস পাওয়া যাওয়ার পরেও সহীহ হাদিসের অনুসরণ না করে তাদের ইমামের মতামতকে অনুসরণ করে। কিন্তু, সকল মাজহাবের ইমামই কি বলেননি সহীহ হাদিসই আমার মাজহাব”?

উত্তর: প্রত্যেক ইমামই যথাসাধ্য সহীহ হাদিস অনুসরণ করেছেন এবং সেই মাজহাবের আলেমরাও সবসময় সহীহ হাদিসের ভিত্তিতেই বিধান দিয়েছেন। কিন্তু, আমাদের মনে রাখতে হবে যে সহীহ হাদিসকে সেভাবেই বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবারা বুঝেছিলেন । এমন বহু সহীহ হাদিস আছে যেগুলো অন্য সহীহ হাদিস বা কুরআনের আয়াত দ্বারা অবলুপ্ত (Abrogate) হয়ে গেছে, আবার এমনও সহীহ হাদিস আছে যেগুলো ১০০% সত্য হওয়ার পরেও সাহাবারা সেগুলির উপর আমল করতেন না, কেন করতেন না সেটা আমাদের অনেক ক্ষেত্রে জানা আছে, অনেক ক্ষেত্রে জানা নেই।

আসুন মালিকি মাজহাব থেকে একটা উদাহরণ দেখা যাক। ইমাম মালিক তার মুওয়াত্তায় নামাজে দাড়িয়ে হাত বুকে রাখতে হবে এই সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু, ইমাম মালিকই তাঁর মাজহাবে হাত ছেড়ে নামাজ পড়তে বলেছেন। কেন? কারণ, ঐ যে – “হাদিস বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবারা তা বুঝেছিলেনইমাম মালিক মদীনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ তাবেঈনদের হাত ছেড়ে নামাজ পড়তে দেখেছেন, তাবেঈনরা এটা দেখেছেন মদীনার সাহাবাদের কাছ থেকে। ইমাম মালিকের এই মতের পক্ষের হাদিসও কিন্তু বুখারী শরীফেই আছে [২৩,২৪,২৫]। বর্ণিত হাদিসটিতে রাসূলুল্লাহ() একজন সাহাবীকে শিখিয়েছেন কিভাবে নামাজ পড়তে হবে, কিন্তু তিনি তাকে হাত বাঁধার কথা বলেননি।  মালিকি মাজহাবের মতে, রাসূলুল্লাহ() কখনো কখনো হাত বেঁধে নামাজ পড়েছেন এটা দেখানোর জন্য যে, ইচ্ছা করলে এভাবেও নামাজ পড়া যায়। উল্লেখ্য, অনেকে বলে থাকে যে, ইমাম মালিক মৃত্যুর আগের শেষ কয়দিন হাতে ব্যথা থাকার কারণেহাত না বেঁধে নামাজ পড়তেন এই কথার কোনও ভিত্তি নেই [৪]।

আবার অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে, অনেক সুন্নাহ/হাদিস আছে যা সালাফদের জানা ছিল, কিন্তু সেই সুন্নাহটি সহীহ হাদিস আকারে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে নাই। কারণ, ইমাম বুখারী (মৃত্যু ২৫৬ হিজরী) বা ইমাম মুসলিম (মৃত্যু ২৬১ হিজরী) যেহেতু মাজহাবের ইমামদের প্রায় ৫০/৬০ বছর পর হাদিস সংগ্রহ শুরু করেছেন, এমন হতেই পারে যে হাদিসটি ইমাম মালিক বা ইমাম আবু হানিফার কাছে সহীহ ছিল, তা বুখারী-মুসলিমের যুগে আসতে আসতে যইফ (দুর্বল) হয়ে গেছে। কিন্তু, মাজহাবের ইমামরা সেই সুন্নাহ সম্পর্কে সহীহ সনদে অবগত ছিলেন এবং সেই অনুসারে তাদের মাসআলা দিয়েছেন।

হাদিসের এ সকল গ্রন্থ সংকলিত হওয়ার পূর্বে যে সব ইমাম অতিক্রান্ত হয়ে গেছেন তাঁরা পরবর্তীদের চেয়ে অনেক বেশী হাদিসের জ্ঞান রাখতেন। কারণ, তাঁদের নিকটে এমন বহু হাদিস ছিল যা আমাদের পর্যন্ত মাজহুল (অজ্ঞাত) বা মুনকাতি’ (বিচ্ছিন) সনদে পৌঁছেছে কিংবা আদৌ পৌঁছেনি।  (রাফউল মালাম আনিল আয়িম্মাতিল আলাম ইবনে তাইমিয়াহ পৃষ্ঠা ১৮। [১৯]

সালাফী যুক্তি ৪: সাহাবাদের তো কোনো মাজহাব ছিল না, আপনারা মাজহাব পেলেন কোত্থেকে?

যুক্তি-খন্ডন: আমরা আগেই বলেছি কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে বিধান দেয়ার উসুল” (Set of Principles) কেই মাজহাব বলে। সাহাবীরাও কিছু উসুলঅনুসরণ করেই বিধান দিতেন। একথা সুবিদিত যে মদীনার সাহাবাদের উসুলকুফার সাহাবাদের উসুলথেকে আলাদা ছিল ।

আর আপনি যদি সাহাবাদের পদ্ধতিই অনুসরণ করতে চান তাহলে আমি বলব সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে ইমাম মালিকের মাজহাব অনুসরণ করা। কারণ, ইমাম মালিকের জীবদ্দশায় এই মাজহাবের নাম কিন্তু মালিকি মাজহাব ছিল না, এর নাম ছিলমাদানী মাজহাব”, কারণ মদীনার সাহাবী ও তাবেঈনরা এই উসুলঅনুসরণ করতেন। ইমাম মালিক শুধু সেই উসুলকে একটা সিস্টেম এর মধ্যে এনে লিপিবদ্ধ করে একে মাজহাব এর রূপ দিয়েছেন।

সালাফী যুক্তি ৫: সব মাজহাব যদি একই কুরআন আর সুন্নাহ এর অনুসরণ করে থাকে, তাহলে এদের বিধানগুলো এত আলাদা কেন?

যুক্তি-খন্ডন: একই কুরআন সুন্নাহ অনুসরণ করার পরেও বিধান আলাদা হয় আলাদা উসুল” [,,১৯] এর কারণে। উসুলএর এই পার্থক্যের কিছু উদাহরণ দেখুন

  • ইমাম মালিক মুরসাল হাদিস (যে হাদিস সাহাবা নয় বরং তাবেঈথেকে বর্ণিত হয়েছে) গ্রহণ করেছেন, আর ইমাম শাফেঈশুধু নির্দিষ্ট কিছু তাবেঈর মুরসাল হাদিস নিয়েছেন।
  • ইমাম মালিক মদীনার তাবেঈদের আমলকে সহীহ হাদিসের বিপরীতে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি হলো যে মদীনার মাটিতে ১০ হাজার সাহাবা শুয়ে আছেন, সেই মদীনার সাহাবা ও তাবেঈদের আমল সহীহ হাদিসের চাইতেও শক্ত দলীল। কারণ, হাদিস বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের চাইতে তাঁদের জ্ঞান নি:সন্দেহে বেশী ছিল।
  • কিছু মুতাওয়াতির হাদিস (যে হাদিস তার সনদের প্রত্যেক স্তরে বহু মানুষ দ্বারা বর্ণিত হয়েছে) আছে যেগুলি কুরআনের আয়াতের সাথে আপাত: দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক (Apparently Conflicting)এই ক্ষেত্রে কি কুরআনের আয়াত নেয়া হবে নাকি হাদিসকে নেয়া হবে তা নিয়ে মাজহাবগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একেক মাজহাব এক্ষেত্রে একেকটাকে প্রাধান্য দিয়েছে।
  • যদি কোনও আহাদ হাদিস (যে হাদিসের সনদের  প্রতিটা স্তরে তিনজনের বেশী বর্ণনাকারী পাওয়া যায় না) কুরআনের কোনো প্রতিষ্ঠিত নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে হানাফী মাজহাব হাদিস সহীহ হওয়া সত্ত্বেও, সেটা না নিয়ে কিয়াস ব্যবহার করে। এটা একটা কারণ যার ফলে আমরা হানাফী মাজহাবে সহীহ হাদিস বিরোধী এত আহকাম (Islamic Ruling) দেখতে পাই।
  • কোন্‌ হাদিসগুলো আম (General), আর কোন্‌ হাদিসগুলো খাস (Specific/Exception) – এই বিষয়ে ইমামদের মতপার্থক্যের কারণেও ফিকহী পার্থক্য হয়।
  • অন্যদিকে হাম্বালী ও সালাফীরা হাদিসকে আক্ষরিক ভাবে মেনে চলেন, ফলে আমরা হাদিসের কিতাবগুলিতে যে হাদিসগুলি পাই, সেগুলোর সাথে এই মাজহাবগুলোর সরাসরি মিল সবচেয়ে বেশী।

আবু-বকর(রা) ও উমার(রা) এর মতপার্থক্য [২৯]: উসুলএর এই ধরনের পার্থক্য সাহাবাদের সময় থেকেই ছিল, আর তাবেঈনদের মধ্যে তো ছিলই। দুইজন সম্পূর্ন ভিন্ন বিধান এর অনুসারী হয়েও দুইজনেই সঠিক হতে পারে, যদি তাদের নিয়ত হয় আল্লাহর হুকুমকে মনে চলা। শ্রেষ্ঠ দুই সাহাবী আবু বকর(রা) ও উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) অসংখ্য বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন, তারপরেও তারা দুইজনেই রাসূলুল্লাহ()-কে নিঁখুতভাবে অনুসরণ করেছেন [২৭]। যেমন আবু বকর(রা) এর খিলাফতকালে সাহাবীদের যে ভাতা দেয়া হতো, তা সকল সাহাবার জন্য সমান অংকের ছিল। আবু বকর(রা) এর যুক্তি ছিল মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন যে তিনি সকল সাহাবার উপরই সন্তুষ্ট (http://quran.com/9/100) , তাই তাঁরা সবাই সমান ভাতা পাবেন।

অন্যদিকে, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) খলীফা হওয়ার পরেই এই নিয়মের পরিবর্তন করলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, যারা ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে তা গ্রহন করেছে, তারা যে কষ্ট সহ্য করেছে সেই তুলনায় যারা পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তারা অনেক কম কষ্ট সহ্য করেছে, ফলে তাদের মর্যাদাও কম। কে কত আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে এর ভিত্তিতে তিনি ভাতার স্কেল নির্ধারণ করেন। এখানে আবু বকর(রা) ও উমার(রা) এর মতামত সম্পুর্ণ বিপরীত কিন্তু তাঁরা দুইজনেরই নিয়ত ছিল রাসূলুল্লাহ() কে  নিঁখুতভাবে অনুসরণ করা। সাহাবাদের জীবন ঘাঁটলে এরকম অগুনতি পরষ্পর-বিরোধী মতামত পাওয়া যায় [২৭]। কিন্তু, যেহেতু তাঁদের প্রত্যেকেরই নিয়ত শুদ্ধ ছিল, কাজেই যিনি যে বিধান অনুসরণ করেছেন, তাঁর জন্য সেটাই শুদ্ধ ছিল।

সালাফী যুক্তি ৬: শাফেঈমাজহাব বলে অজু করে স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অজু থাকে না, হানাফী মাজহাব বলে অজু থাকে। কিন্তু, দুইটা তো একই সাথে সঠিক হতে পারে না। তার চাইতে যে মতামতটা অধিকতর সঠিক সেটা অনুসরণ করাই কি উচিত না?

যুক্তি-খন্ডন: প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক মাজহাব তাদের উসুল” (Set of Principles) অনুসারে যেটা সবচেয়ে সঠিক সেটাই বেছে নিয়েছে। স্ত্রীকে স্পর্শ করলেও অজু থাকে” – হানাফী মাজহাবে এটাই সঠিক। কারণ, আবু দাউদের সহীহ হাদিসে আছে রাসূলুল্লাহ() অজু করার পর আয়েশা(রা) কে স্পর্শ করা সত্ত্বেও আবার অজু না করেই নামাজ পড়েছেন। অন্যদিকে, শাফেঈমাজহাব এর মতে  “স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অজু থাকে না ” –  এটাই সঠিক (এই বিষয়ে শাফেঈ মাজহাবের বিস্তারিত প্রমাণের জন্য এই লেখাটি পড়ুন)। কারণ, তাদের মতে সূরা মায়িদার ৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন – “স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অজু থাকবে নাএবং এই আয়াতটি আবু দাউদের হাদিসের উপর প্রাধান্য পাবে, ফলে আবু দাউদের হাদিসের বিধানটি অবলুপ্ত (Abrogate) হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। কাজেই, আপনি যদি বলে থাকেন ইমাম আবু হানিফা এর মতামত এক্ষেত্রে ইমাম শাফেঈর মতামতের চেয়ে বেশী সঠিক, তাহলে আপনি আসলে বলছেন যে সেটা আপনার উসুলঅনুসারে বেশী সঠিক।

সালাফী যুক্তি ৭: আব্বাসীয় শাসন আমলে এরকম ফতোয়া ছিল যে, হানাফীরা শাফেঈদের বিয়ে করতে পারবে না। শুধু তাই না, দামেস্ক ও মক্কায় চার মাজহাবের জন্য চারটি পৃথক মিহরাব ছিল এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন জামাতে নামাজ পড়ত। কাজেই, এভাবে করে মাজহাব কি মুসলিম উম্মাহ এর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে নাই?

উত্তর: মাজহাব নিয়ে এ ধরনের বাড়াবাড়ি অতীতে হয়েছে একথা সত্য এবং মাজহাবের নামে মুসলিম উম্মাহর এইরকম বিভক্তি মোটেও কাম্য নয় [৪]। কিন্তু, আপনি যখন জানবেন কেন এরকম করা হয়েছিল, তখন পুরো বিষয়টাকে ভিন্ন দৃষ্টিভংগীতে দেখতে পারবেন।

হানাফী আর শাফেঈরা একে অপরকে বিয়ে করতে পারবে না এই ফতোয়া এই জন্য দেয়া হয়েছিল যে, দুইটি ভিন্ন মাজহাবের বিয়ে সংক্রান্ত বিধি-বিধানগুলো ভিন্ন হওয়ায়, একজন মুফতীর পক্ষে কিছু কিছু ব্যাপারে মতামত (Islamic Ruling) দেয়া কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমন এক মাজহাব মনে করে ডিভোর্সের জন্য একবার তালাক বলতে হবে, আর আরেক মাজহাব মনে করে ডিভোর্সের জন্য তিনবার তালাক বলতে হবে।  স্বামী-স্ত্রী দুইজন যদি দুই ভিন্ন মাজহাবের মানুষ হয়, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, কোন্ মাজহাব অনুসারে তাদের মামলা পরিচালনা করা হবে? এই ধরনের ঝামেলা এড়ানোর জন্য তখনকার মুফতিরা এক মাজহাবের মানুষ অন্য মাজহাবের মানুষকে বিয়ে করতে পারবে না” – জাতীয় উদ্ভট ফতোয়া দিয়েছিল, যেটা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। তাদের উচিত ছিল কিভাবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বজায় রাখা যায় তা নিয়ে চিন্তা করা [৪]।

মক্কায় আর দামেস্কে চার মাজহাবের জন্য চার মিহরাব স্থাপন হলো মাজহাব-সন্ত্রাসের এক চরম উদাহরণ, যা অস্বীকার করার উপায় নাই [৪]। কিন্তু এর দোষ আপনি মাজহাবকে দিতে পারেন না, এর জন্য দোষ দিতে হবে মানুষের চরমপন্থী চিন্তাভাবনাকে। চরমপন্থী চিন্তা-ভাবনা সব সময়ই খারাপ, তা সে মাজহাব নিয়েই হোক, সালাফীবাদ নিয়েই হোক আর নাস্তিকতা নিয়েই হোক। মাজহাবী চরমপন্থার যে উদাহরণ আপনি দিচ্ছেন, সেই একইরকম উদাহরণ নাস্তিকেরা ব্যবহার করে এটা প্রমাণ করার জন্য যে ধর্ম খারাপকারণ, ধর্মের কারণে আগের শতাব্দীগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু, ভেবে দেখুন আগের শতাব্দীর সেই গণহত্যাগুলোর জন্য কি ধর্ম দায়ী নাকি মানুষের চরমপন্থী চিন্তা-ভাবনা আর অন্য মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দায়ী?

সালাফী যুক্তি ৮: রাসূলুল্লাহ() বলেছেন সেভাবে নামাজ পড় যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখ, তারপরেও মাজহাবীরা সহীহ হাদিসের বিপরীতে নামাজ পড়ে  কেন?

উত্তর: লক্ষ্য করুন রাসূলুল্লাহ() বলেছেন – “সেভাবে নামাজ পড়ো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখ” (বুখারী)। মাজহাবীদের মতে রাসূলুল্লাহ() এর মতো করে নামাজ পড়ার দাবী যতটা ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা করতে পারেন, শাইখুল হাদিস আলবানী ততটুকু করতে পারেন না [৪]। কারণ, ইমাম আবু হানিফা নামাজের মাসআলা নিয়েছেন মূলত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এর ছাত্রদের থেকে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ মক্কার প্রথম ১০ জন ইসলাম গ্রহনকারীদের একজন যিনি দীর্ঘ ২০ বছর রাসূলুল্লাহ() এর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়েছেন। সাহাবারা রাসূলুল্লাহ() কে নামাজ পড়তে দেখেছেন”, আবার তাবেঈরা সাহাবাদের নামাজ পড়তে দেখেছেনআপনাকে স্বীকার করতে হবে কোন কিছু পড়ে শেখারচেয়ে উস্তাদের কাছ থেকে সরাসরি দেখে শিখলেভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

অন্যদিকে, ইমাম মালিক তাঁর নামাজের মাসআলাগুলো নিয়েছেন [৪] প্রধানত: আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) এর ছাত্র ও মুক্তিকৃত দাস নাফি’ (মৃত্যু ১১৭ হিজরী) থেকে, আর নাফিনিয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) থেকে, যিনি সব সাহাবীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ() কে সবচেয়ে অনুকরণ বেশী করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) সেই ধরনের জুতা পড়তেন যা রাসূলুল্লাহ() পড়তেন, ঠিক একই কাপড় পড়তেন যা রাসূলুল্লাহ() পড়তেন। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব যে উনি নামাজ পড়তেন যেভাবে রাসূলুল্লাহ() পড়তেন না? ইমাম বুখারী নিজে ইমাম মালিক -> নাফি’ -> আব্দুল্লাহ ইবনে উমার -> রাসূলুল্লাহ()এর সনদ কেস্বর্ণালী সনদ” (সিলসিলাতুল যাহাব / The Golden Chain of Narrators) বলে আখ্যায়িত করেছেন।     এখন আপনিই বলেন রাসূলুল্লাহ() কিভাবে নামাজ পড়েছেন, সেই নামাজ কি ইমাম মালিক বেশী বলতে পারবেন, না ১৪০০ বছর পরের কোনও আলেম সঠিকভাবে বলতে পারবে?

আমাদের মনে রাখতে হবে, কিছু কিছু সুন্নাহ আছে যেগুলো লিখিত আকারে সংরক্ষিত হয়নি। সাহাবারা, তাবেঈরা  অনেক সুন্নাহই সংরক্ষণ করেছেন তাদের কাজের (Practise) মাধ্যমে। আর মাজহাবের ইমামরা অনেক ক্ষেত্রেই সহীহ হাদিসকে বাদ দিয়ে সালাফদের কাজকে (Practise) প্রাধান্য দিয়েছেন। এর কারণ হলো সেই ৪ নং পয়েন্ট – “হাদিস বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবারা বুঝেছিলেনউদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মালিকি মাজহাবে রাফউল ইয়াদাইনকরা হয় না। যদিও ইমাম মালিক রাফউল ইয়াদাইনের হাদিস সম্পর্কে জানতেন। ইমাম মালিকের মতামত হচ্ছে রাসূলুল্লাহ() মাঝে মধ্যে রাফউল ইয়াদাইন করে দেখিয়েছেন যে, নামাজের যে কোনো আল্লাহু আকবারের সাথে চাইলে হাত তোলা যায়, এটা মাকরুহ নয়। এই মতামতের পিছনে যুক্তি কি? এর যুক্তি হলো রাফউল ইয়াদাইনের হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবা আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) নিজেই নামাজে রাফউল ইয়াদাইন করতেন না, কাজেই এর থেকে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ()ও সাধারণত রাফউল ইয়াদাইন করতেন না। তাই, ইমাম মালিক রাফউল ইয়াদাইনের হাদিস জানা সত্ত্বেও তার পক্ষে মত দেননি।

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে রাসূলুল্লাহ() কিন্তু বলেছেন – “সেভাবে নামাজ পড়ো যেভাবে আমাকে পড়তে দেখ” (বুখারী), তিনি বলেননি – “সেভাবে নামাজ পড়ো যেভাবে আমাকে নিয়ে লেখা হয়েছে।  উপরে বর্ণিত কারণে এই দেখারব্যাপারটা কেউ যদি দাবী করতে পারে তবে সেটা ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফারা যতটুকু করতে পারেন, ১৪০০ বছর পরের কেউ ততটুকু করতে পারবে না।

 

মাজহাবীদের যুক্তি ও প্রতি-উত্তর

মাজহাবী যুক্তি ১: কেউ যদি নির্দিষ্ট কোনো মাজহাব অনুসরণ না করে, তাহলে সে বিভিন্ন মতামত থেকে তার যেটা পছন্দ হবে শুধু সেটা বেছে নিবে। ফলে ধর্মীয় বিধানগুলি সে তার খেয়ালখুশী মতো পালন করবে। কাজেই, একজন মুসলিমকে সবসময় নির্দিষ্ট একটি মাজহাবই অনুসরণ করতে হবে।

যুক্তি-খন্ডন: কেউ যদি তার ইচ্ছা মতো চলার জন্য সব ক্ষেত্রে প্রত্যেক মাজহাবের সবচাইতে সহজ বিধানটা নেয়া শুরু করে, তাহলে সে অবশ্যই ভুল করবে কারণ, “মুসলিমসে-ই যে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু এই ব্যক্তি চাচ্ছে ইমামদের মত পার্থক্যকে নিজের বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার মাধ্যমে কার্যত নিজের দ্বীনকে ধ্বংস করতে।

তবে এর মানে এটাও নয় যে, তাকে চার মাজহাবের একটিকে বেছে নিতেই হবে এবং সবসময় সেটাকেই মানতে হবে। কোনও বিষয়ে বিভিন্ন মতামত সম্পর্কে জানার পর কোনো ব্যক্তির কাছে যদি নির্দিষ্ট একটি মতামতকে অন্য মতামতের চাইতে বেশী সঠিক মনে হয়, তাহলে তার জন্য ঐ নির্দিষ্ট মতামতকে মানার মধ্যে দোষের কিছু নেই। মালিকি মাজহাবের ইমাম শাতিবী বহু ক্ষেত্রে শাফেঈমাজহাব এর মতামতকে অনুসরণ করতেন এবং শিক্ষা দিতেন [৪]। হানাফী মাজহাবের  উসুলের একটি পয়েন্টই হলো যে, যদি কোনো বিষয়ে তাদের মাজহাবের ভিতর কোনো গ্রহণযোগ্য মতামত না পাওয়া যায়, তাহলে মালিকি মাজহাবের মতামত অনুসরণ করা।

এমন কি অনেক ক্ষেত্রে যদি এমন হয় যে, কোনো বিষয়ে আপনার দুইটি মতামত জানা আছে যার দুইটিই কুরআন- সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত,  কিন্তু একটি মতামত সহজ আর আরেকটি কঠিন, এবং পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে আপনার পক্ষে কঠিন মতামতটি পালন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে, এই ক্ষেত্রেও আপনি সহজ মতামতটি অনুসরণ করতে পারেন (একে তালফিকবলে) [১১] । কারণ আয়েশা(রা) বলেছেন:রাসূলুল্লাহ()কে দুইটা হালাল কাজের মধ্যে বেছে নিতে হলে তিনি সহজটাকে বেছে নিতেন।  একথা সুবিদিত যে তাবেঈরা কঠিন ফতোয়ার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) এর কাছে যেতেন আর সহজ ফতোয়ার জন্য যেতেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এর কাছে [৪,৭]।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কঠিন মতামতের বিপরীতে সহজ মতামত গ্রহণ করার প্রচলন সাহাবা ও তাবেঈদের মধ্য থেকেই প্রচলিত। কাজেই কোনও বিষয়ে কোনও ব্যক্তি নিতান্ত অপরাগ হয়ে থাকলে, সহজ মতামত অনুসরণ করা যেতে পারে।

মাজহাবী যুক্তি ২: আমরা যদি ইসলামের গত ১১০০ বছরের ইতিহাস দেখি তাহলে এমন কোনো আলেম পাবো না, যিনি মাজহাব অনুসরণ করেননি। কাজেই, আমাদেরকেও চার মাজহাবের এক মাজহাব অনুসরণ করতেই হবে।

যুক্তি-খন্ডন: একথা সত্য যে, গত ১১০০ বছরের যত বিখ্যাত আলেম ছিলেন তাদের সবাই কোনো না কোনো মাজহাবের অনুসারী ছিলেন।  যেমন

হানাফী মাজহাব শায়বানী, আবু ইউসুফ, তাহাউই, মোল্লা আলি কারি

মালিকি মাজহাব ইবন রুশদ, কাদি ইবনুল আরাবী, ইবনে আব্দুল বার, কুরতুবী, শাতিবি

শাফেঈ মাজহাব ইবনে সালাহ, ইমাম নাবাউই, ইবনে হাজার আসকালানী, ইবনে কাথির, আস-সুয়ূতি, গাজ্জালি

হাম্বালী মাজহাব ইবনে তাইমিয়াহ, ইবনে কুদামা, ইবনে রজব, ইবনুল কাইয়ূম, ইবনে জাউযি

কিন্তু, লক্ষনীয় যে, এই সব ইমামরা প্রত্যেকেই বহু ক্ষেত্রে তাদের মাজহাব যে মতামত বলে সেই মতামতের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।  শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ, ইমাম শাতিবি সহ অনেক ইমাম অনেক ক্ষেত্রে নিজের মাজহাবের উসুলএর বিপরীতে এমন কি অন্য মাজহাবের উসুল পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন [৪,৭]। কাজেই, একজন মানুষকে সব সময় সব বিষয়ে একটা মাজহাবেরই সব বিধান মেনে চলতে হবে তা ঠিক না।

তবে আলেমরা বলেন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে (Domain) একই মাজহাবের/ইমামের বিধি-বিধান মেনে চলা উচিত । যেমন আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন: আপনি শাইখুল হাদিস নাসিরুদ্দীন আলবানীর ফিকহ অনুসারে নামাজ পড়বেন, তাহলে পুরো নামাজ উনার ফিকহ অনুসারেই পড়ুন। কিছু অংশ আলবানী এর ফিকহ অনুসারে আর কিছু অংশ হানাফী মাজহাব অনুসারে পড়বেন এটা ঠিক নয়। আবার যদি সিদ্ধান্ত নেন, আপনি রোজা রাখার ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করবেন, তাহলে রোজার সব বিধি-বিধান হানাফী মাজহাব অনুসারেই পালন করুন, এর সাথে অন্য কোনো মাজহাবকে মেলাবেন না।  কেন? কারণ, একই বিষয়ে বিভিন্ন মাজহাবের সংমিশ্রণ ঘটলে দ্বীন নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

উদারহরণস্বরুপ [৪,১১] বলা যায় হানাফী মাজহাবে বিয়ের জন্য ওয়ালী লাগে না, মালিকি মাজহাবে সাক্ষী লাগে না, আর কোনো কোনো ইমামের মতে মোহর এর পরিবর্তে ইলম শিক্ষা দিলেও চলে। কাজেই, কেউ যদি তার বিয়েতে সব মাজহাবের সবচেয়ে সহজ বিধানটি বেছে নেয়, তাহলে কার্যত সে কোনো শর্ত ছাড়াই, অর্থাৎ কোনো ওয়ালী, সাক্ষী, সম্পদের মোহর ছাড়াই বিয়ের নাম করে ব্যভিচার করতে পারবে। এর জন্য, আলেমরা এই বিষয়ে একমত যে, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মাজহাবের সংমিশ্রন করা যাবে না।

মাজহাবী যুক্তি ৩: কেউ যখন মাজহাব অনুসরণ করে, তখন সে ঐ মাজহাবের হাজার হাজার ইমাম যে ব্যাপারে ঐক্যমত প্রকাশ করেছে তা অনুসরণ করে। অন্যদিকে, কেউ যখন ঐ মাজহাবগুলোর বাইরে যেয়ে কোনো সালাফী ইমামের মতামত (Islamic Ruling) গ্রহণ করে তখন সে হাজার ইমামের বিপরীতে একজন ব্যক্তি ইমামকে অনুসরণ করে। হাজার হাজার ইমামের মতামতের বিপরীতে একজন ইমামের মতামত গ্রহণ করা সঠিক হতে পারে না। এ কারণে, চার মাজহাবের অনুসরণ না করে কোনো সালাফী ইমামের অনুসরণ করা ঠিক নয়।

যুক্তি-খন্ডন:  এই চিন্তাটা আসলে নতুন কিছু না। শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও ইসলামের ইতিহাসের বেশ কিছু বাঘা-বাঘা আলেম এই মত দিয়েছেন যে চার মাজহাবের বাইরে অন্য কোনো মাজহাব অনুসরণ করা যাবে না [৭,২৬]। তাদের যুক্তি হলো এই চার মাজহাবের মতামতগুলি যেভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেই মাজহাবগুলোর হাজার-হাজার আলেম মিলে বিশ্লেষণ (Analysis) করেছেন, এই চার মাজহাবের বাইরের মতামতগুলো নিয়ে সেভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। যেহেতু এগুলোকে নিয়েই সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং প্রত্যেক মাজহাবের হাজার হাজার ইমাম সেই মাজহাবের ফিকহ (Islamic Ruling) গুলোকে সমর্থন করেছেন, কাজেই এই মাজহাবগুলোর বাইরে অন্য মত অনুসরণ করা ঠিক হবে না। ইমাম নাবাউই ও ইবনে সালাহ এরকম মনে করতেন। আর ইবনে রজব তো এই বিষয়ে একটি পুস্তিকা পর্যন্ত লিখেছেন। কিন্তু, ইবনে তাইমিয়াহ সহ বহু আলেম এই মতের বিরোধীতা করেছেন। তাদের মতে, বহু সংখ্যক আলেমের বিপরীতে কম সংখ্যক আলেমের মতামত কখনো কখনো শুদ্ধ হতে পারে [৭]।

বহু সাহাবার মতের বিপরীতে একজন সাহাবীর মত: রাসূলুল্লাহ() এর সিরাহ থেকে আমরা এরকম উদাহরণ পাই যেখানে অনেক সাহাবার ঐক্যমতের বিপরীতে একজন সাহাবীর মতামত শুদ্ধ ছিল। মক্কা বিজয়ের ঠিক আগে রাসূলুল্লাহ() যাতুস সালাসিল” [২৯] অভিযানে সবাই কে অবাক করে দিয়ে আমর বিন আসকে নেতৃত্বে দেন, যিনি মাত্র ২ মাস আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। অভিযানের কোনো এক রাতে ঘুমের মধ্যে আমর ইবনে আস এমন স্বপ্ন দেখেন যার ফলে তাঁর ফরজ গোসল করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু, তিনি ফজরের নামাজের সময় তিনি প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করেন। তাঁর যুক্তি ছিল এত ঠান্ডার মধ্যে গোসল করলে তিনি ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, এমনকি মারাও যেতে পারেন। আর আল্লাহ কোরআনে মানুষকে বলেছেন নিজেকে হত্যা কোরো না

এই খবর ছড়িয়ে পড়লে বাকী সাহাবারা আমর এর ইমামতিতে নামাজ পড়তে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করেন (পরে অবশ্য ঐক্যের কথা বিবেচনা করে তাঁরা আমর এর পিছনেই নামাজ পড়েন)। কারণ তাদের কথা হলো ঠান্ডার অজুহাতে তায়াম্মুম করা যাবে না, তায়াম্মুম শুধু তখনই করা যায় যখন পানি পাওয়া যায় না। নতুন সাহাবী আমর এর বিপরীত ক্যাম্পে কারা ছিলেন জানেন? ছিলেন আবু বকর(রা), উমার (রা) এবং আবু উবাইদাহ বিন জাররাহ এর মতো সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবারা।  কিন্তু, অভিযান শেষে যখন সাহাবারা ফিরলেন তখন রাসূলুল্লাহ() জানালেন কেউ যদি এমন ভয় করে যে পানি স্পর্শ করলে তার মৃত্যু হবে বা ভয়াবহ অসুখ হবে তাহলে সে ফরজ গোসল না করে তায়াম্মুম করতে পারে! সুতরাং, দেখা যাচ্ছে শত শত সর্বোচ্চ মর্যাদার সাহাবার বিপরীতে একজন মাত্র সাহাবার মতামতও সঠিক হতে পারে।

মাজহাবী যুক্তি ৪: সালাফী মতবাদ শুরু হয়েছে মাত্র ২০০-২৫০ বছর আগে। এর আগের হাজার বছর ধরে মাজহাবীরাই ইসলামকে সংরক্ষণ করে এসেছে। কাজেই, নতুন করে আর সালাফী মতবাদ প্রচারের দরকার কি? তার চেয়ে তো আগের চার মাজহাবই ভালো ছিল।

যুক্তি-খন্ডন: বর্তমানে আমরা যে সালাফী মুভমেন্ট দেখি, যেখানে মাজহাব অনুসরণ না করে সরাসরি কুরআন-সুন্নাহকে অনুসরণ করতে বলা হয়, আমরা যদি এর ইতিহাসের দিকে তাকেই তাহলেই এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারব [৯]। বর্তমানে আমরা যদিও সালাফী বলতে মূলত সৌদি-আরব/মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় এর আলেমদের বুঝি। কিন্তু, যে তিনজন ব্যক্তির হাত ধরে সালাফীশব্দটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তারা কিন্তু মিশরী/আফগানী ছিলেন। এরা হলেন

  • জামালউদ্দীন আফগানী (মৃত্যু ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)
  • মুহাম্মাদ আব্দুহ (মৃত্যু ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ)
  • রশীদ রিদা (মৃত্যু ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন বিশ্বজুড়ে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে তখন আফগানী, আব্দুহ, রিদারা চিন্তা করা শুরু করেন কেন আমরা মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত পিছিয়ে আছি? আমাদের মুসলিমদের উচিত ছিল দুনিয়ার নেতৃত্বে থাকা, কিন্তু কেন আজ ইউরোপিয়ান-আমেরিকানরা এর নেতৃত্বে আছে? আব্দুহ চিন্তা-ভাবনা করে বের করলন এর পেছনে আছে মুসলিমদের গোঁড়া মন-মানসিকতা। মাজহাবগুলো  প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো যখন মুসলিমদের খিলাফত ছিল, জীবন যাত্রা ভিন্ন মাত্রার ছিল। পরিবর্তিত এই বিশ্বের সাথে মাজহাবি বিধানগুলো তাল মেলাতে পারছে না, কারণ মাজহাব তো আল্লাহর দেয়া না, মাজহাব মানুষের তৈরী। কাজেই, আব্দুহ বললেন, আমাদের ফিরে যেতে হবে কুরআন সুন্নাহর কাছে। যেহেতু ওগুলো আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে, তাই শুধু আগের যুগেরই নয়, আধুনিক যুগের সব সমস্যার সমাধানও কুরআন-হাদিসের মধ্যেই পাওয়া যাবে।  বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব যেখানে মুসলিমদের খিলাফত নেই (বা থাকলেও নামে মাত্র আছে), যেখানে নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করতে চায়,  যেখানে নিত্য-নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়ে চলেছে এগুলোর আলোকে কুরআনসুন্নাহকে আমাদের নতুন করে পড়তে হবে।   আব্দুই সর্বপ্রথম এই চিন্তা-ভাবনাকে সালাফীনাম দেন। কারণ, সালাফদের সময় প্রচলিত চার মাজহাবের কোনটিই প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়নি, সালাফরা কুরআনসুন্নাহ থেকে সরাসরি বিধান নিতেন। কিন্তু, বর্তমান সময়ে আব্দু এর আন্দোলনকে সালাফী বলা হয় না, এটা হয়ে গেছে মডার্নিষ্ট ইসলামবাপ্রগেসিভ ইসলাম

আব্দুহ ব্যবহৃত সালাফীশব্দটা নাসিরুদ্দীন নামক এক তরুন আলবেনীয় জিনিয়াস খুব পছন্দ করে ফেলেন।  এই তরুন পরবর্তীকালে হয়ে উঠেন শাইখুল হাদিস নাসিরুদ্দীন আলবানী, যার সারা জীবনের গবেষনা ছিল সহীহ হাদিসের ভিত্তিতে ফিকহী সিদ্ধান্ত দেয়া। নাসিরুদ্দীন আলবানী তাঁর কর্মপন্থাকে সালাফীনামে প্রচার করেন, যা আগে নাজদি দাওয়ানামে পরিচিত ছিল। নাজদি দাওয়াশুরু হয়েছিল শেইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (মৃত্যু ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দ) এর মাধ্যমে । কিন্তু, বর্তমান সময়ে সালাফীবলতে আব্দুহ কে বুঝানো হয় না, বুঝানো হয় নাসিরুদ্দীন আলবানি, মুহাম্মাদ ইবনুল উথাইমিন, ‘আব্দুল আযীয বিন বাজ  ও তাঁদের সমমনাদেরকে। উল্লেখ্য, সালাফী ইমামদের প্রায় প্রত্যেকেই ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (মৃত্যু ১৩২৮ খ্রীষ্টাব্দ) এর মতামতকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

সুতরাং ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, আধুনিক যুগের সাথে মাজহাবগুলো তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত সংকীর্ণমনতার কারণে যুগের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। কবর পূজার বিরুদ্ধে নমনীয় অবস্থান, যইফ (দুর্বল) হাদিসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নেয়া, ইউরোপিয়ানদের ভাষা-খাদ্য-কাপড়-প্রযুক্তি ইত্যাদি ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি এই জাতীয় উদ্ভট সব ফতোয়া মুসলিম জাতিকে ক্রমেই পেছনের দিকে টেনে ধরছিল। এই ধরনের ব্যর্থতাগুলোই সালাফী আন্দোলনকে বেগবান করে, যা ছিল সময়ের দাবী। সাথে সাথে, একথাও স্বীকার করতেই হবে যে সালাফী আন্দোলন মানুষকে সরাসরি কুরআন সুন্নাহ পড়তে, তাদের অর্থ বুঝতে উৎসাহী করেছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মুসলিম তরুনদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান চর্চার যে জোয়ার আমরা দেখতে পাই, তার পেছনে সালাফী আন্দোলনের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

আমাদের কি করণীয়

১। মাজহাব অথবা কোনো সালাফী ইমাম যাকে আপনার কাছে কুরআন-সুন্নাহর বেশী কাছাকাছি মনে হয় তাকেই অনুসরণ করুন [৪,,,২৬]। এমন মাজহাব / ইমামকে অনুসরণ করুন যার থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা নয়, একটি ইবাদতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো জ্ঞান নিতে পারবেন। ইসলামের মৌলিক ইবাদত ও দৈনন্দিন লেন-দেন, চলাফেরার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিধান আপনার পছন্দের মাজহাব / ইমাম থেকে ভালোভাবে জানুন এবং পালন করুন।

২। কোনো একটি নির্দিষ্ট ইবাদতের ক্ষেত্রে (যেমন নামাজ) একটি নির্দিষ্ট মাজহাব বা একজন নির্দিষ্ট ইমামকে অনুসরণ করুন [৪,১১,২৬]। একই ইবাদতের মধ্যে একাধিক মাজহাব বা একাধিক ইমামের ফিকহ (Understanding) কে মেলাবেন না।

৩। যদি পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে আপনি যে মাজহাব বা ইমামের অনুসরণ করেন তার কোনও নির্দিষ্ট হুকুম পালন করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে যে মাজহাব / ইমামের ফিকহ আপনার কাছে সহজ মনে হয় সেটাকে অনুসরণ করতে পারবেন [৪,১১]। এর উদাহরণ হিসেবে আলেমরা বলে থাকেন যারা আমেরিকা / ইউরোপে অফিসে চাকুরী করে, তারা যদি অজুর সময় জুতা খুলে পা ধুতে অসুবিধা বোধ করে, তাহলে তারা হাম্বালী মাজহাবের ফিকহ অনুসারে কেবল মোজা নয়, জুতার উপর দিয়েও মাসাহ করতে পারবে (শর্ত হলো যখন শেষবার জুতা পরা হয়েছিলো তখন তার অজু ছিল ও পায়ের টাখনু সহ ঢাকা থাকতে হবে) [বিস্তারিত এখানে]

সহজ মতামত গ্রহণের আরেকটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো জুমআর নামাজের ওয়াক্ত নির্ধারণ। হাম্বালী মাজহাবের মতে জুমআর নামাজের ওয়াক্ত যুহরের নামাজের ওয়াক্তের চেয়ে ব্যাপক। তারা মনে করে- জুমআর নামাজের ওয়াক্ত যুহরের নামাজের আরো আগেই শুরু হয়ে যায় (এক্ষেত্রে তাদের দলীল হলো  উহুদের যুদ্ধের প্রস্তুতির দিনের হাদিস, যা থেকে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ(সা) সেদিন যুহরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগেই জুমআর নামাজ পড়িয়েছিলেন ) ।  অন্য মাজহাবগুলো হাম্বালী মাজহাবের এই মতের সাথে একমত পোষণ না করলেও উত্তর আমেরিকার মসজিদগুলোতে (এমনকি যে মসজিদের ইমাম হাম্বালী নন) দেখা যায় তারা সবসময় দুপুর ১টার সময় জুমআর নামাজ শুরু করে, যদিও দেখা যাচ্ছে সেদিন যুহরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু দেড়টার সময়। উত্তর আমেরিকার মসজিদের ইমামরা এমন করেন কারণ দেড়টার সময় নামাজ শুরু করলে অধিকাংশ মুসলিমের পক্ষে লাঞ্চ-ব্রেকে বের হয়ে নামাজ আদায় করা সম্ভব  হবে না।  কাজেই, এই ক্ষেত্রে সহজ মতামতটি অনুসরণ করা হচ্ছে সমস্ত মুসলিম উম্মাহর মঙ্গলের কথা চিন্তা করে।

৪। আপনার এলাকার ভালো আলেমের সাথে যোগাযোগ রাখুন। যেসব বিষয়ের শারঈবিধান আপনি যেখানে বাস করেন তার পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সেগুলো ব্যাপারে আপনার এলাকার ইমামই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন [৯]। যেমন দেশে কোনও ব্যাপারে আন্দোলন চলতে থাকলে আপনার তাতে অংশগ্রহণ করা উচিত হবে কিনা তা সৌদি আরব বা আমেরিকার আলেমের চেয়ে বাংলাদেশের আলেমই ভালো বলতে পারবেন।

৫। অন্য মাজহাব / ইমামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। আপনি আপনার মাজহাব / ইমাম সম্পর্কে যতটা নিশ্চিত, অন্য ব্যক্তিও তার মাজহাব / ইমাম সম্পর্কে ততটাই নিশ্চিত। জেনে রাখুন যে, শরীয়তের মাত্র ২০% বিষয়ে ইমামদের মধ্যে ইজমা’ (ঐক্যমত) রয়েছে, আর বাকী ৮০% বিষয়েই তাদের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত মতপার্থক্য রয়েছে [১০]।  এই ধরনের মতপার্থক্য আবু বকর (রা), উমার (রা) এর সময় থেকেই চলে আসছে। কাজেই মতপার্থক্যের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিন। অন্য কাউকে ফিকহি বিষয়ে জ্ঞান দেয়া থেকে বিরত থাকুন, যদি না বিষয়টি সেই অবশিষ্ট ২০% এর মধ্যে পড়ে, যে ব্যাপারে ইমামদের ইজমা’ (ঐক্যমত) রয়েছে।

 শেষ কথা:

আসুন, কিছুক্ষণের জন্য উল্টোভাবে ভেবে দেখি ফিকহ নিয়ে ইমামদের মধ্যে যদি মতপার্থক্য না থাকতো তো কি হতো? আল্লাহ কি চাইলে তার দ্বীনকে এমন করতে পারতেন না যে কোনও বিধান নিয়েই কোনও মতপার্থক্য হতো না? সত্যিই যদি এমন হতো তাহলে নাজিলের ১৪০০ বছর পরেও এসে মানুষ এখনও কুরআন-হাদিস নিয়ে যত আগ্রহ সহকারে গবেষনা করছে, সেই আগ্রহে ভাটা পড়তো। আবার, যে ব্যক্তি কঠিন নিয়ম পালন করতে পারছেন না তিনি দ্বীনের কঠোরতার কারণে হয়ত ধর্মই ত্যাগ করে ফেলতেন। মতপার্থক্য থাকার কারণে বিরূপ পরিস্থিতি পড়ে অপেক্ষাকৃত সহজ মতামতটি অনুসরণ করে অন্তত তিনি তার দ্বীন তো রক্ষা করতে পারছেন।

ইসলামের বিভিন্ন হুকুম নিয়ে মতপার্থক্য করার সুযোগ থাকার কারণেই কিন্তু এই দ্বীন এর ফিকহগুলো মৃত নয়, জীবিত। আর ইসলাম জীবিত ধর্ম বলেই সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক, মানব সমাজ যতই বদলে যাক সকল পরিস্থিতিতেই ইসলাম সমান ভাবে কার্যকর।

আসুন আমরা মাজহাবী-সালাফী পার্থক্য ভুলে যেয়ে একে অপরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখি, একে অপরের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে চেষ্টা করি। আমরা মুসলিমরা যেদিন অন্য মাজহাব ও অন্য মতের ইমামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারবো, শুধু সেই দিনই সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।

তোমরা আল্লাহর দড়িকে (কুরআন) শক্ত করে আঁকড়ে ধরো, আর দলে দলে ভাগ হয়ে যেয়ো না … (সূরা আলে-ইমরান:১০৩)     

শেইখ উথাইমিন, সালিহ আল ফাউযান এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ সালাফী ইমামরা সর্বদাই মাজহাবী ইমামদের শ্রদ্ধা করেছেন। তাঁরা বলেছেন – “আমি সালাফী তাই আমিই সহীহ, আর বাকী সবাই জাহান্নামীজাতীয় ধারণা পোষন না করতে  আবার, আমাদের সময়ের জনপ্রিয় মাজহাবী বক্তা হামযা ইউসুফ [৪], আব্দুর রহমান বিন ইউসুফেরাও [২৬] বলেছেন: কেউ যদি মনে করে মাযহাবের চেয়ে সালাফী ইমামের মতামত অধিক সঠিক, তাহলে সেই ইমামকেই সে অনুসরণ করুক এতে সমস্যার কিছু নেই। অনুকরণীয় এই সব ইমামরা বুঝতে পেরেছেন নিজেকে হানাফী বা সালাফী হিসেবেচিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো মহান আল্লাহর কাছে ভালো মুসলিম হিসাবে কবুল কর ।

References:

  1. The Prophet’s () Prayer from the Beginning to the End as Though You See it – Shaykul Hadith Muhammad Naasir-ud-Deen Al-Albaani
  2. Unity of the Muslim Ummah – Dr. Zakir Naik
  3. The Madhab of Rasool Allah () – Dr .Bilal Philips
  4. Maliki Fiqh – Hamza Yusuf
  5. Why follow a Madhab Instead of Sahih Hadith – Mufti Abdur Rahman ibn Yusuf
  6. The Madhab of Imam Ahmad Ibn Hanbal – Shatibi Center of Islamic Sciences
  7. The Issue of the Madhab and Taqleed – Shatibi Center of Islamic Sciences
  8. Which Madhab to Follow? – Dr. Yasir Qadhi
  9. Towards an Ecumenical Conception of Salafiyyah – Dr. Yasir Qadhi
  10. “We follow only the Quran and Sunnah” – Muhammad Haq (Virtual Mosque Blog)
  11. Choosing Opinions that Suit Your Desires – Yahya Ederer (Virtual Mosque Blog)
  12. Who and What is a Salafi – Nuh Ha Mim Keller (http://www.sunnah.org/aqida/aqida11.htm)
  13. Meaning of the word Salaf http://wayofthesalaf.tumblr.com/TheWordSalaf
  14. What does the word Salaf means in Arabic.
  15. Foundations of Islamic Studies – Dr. Bilal Philips
  16. Tolerance of Fiqh Issues – Ismail Kamdar (Muslim Matters Blog)
  17. Article about Imam Malik on http://en.wikipedia.org/wiki/Malik_ibn_AnasWikipedia
  18. Article about Imam Malik on IslamicEncyclopedia.org
  19. আদিল্লাতুল হানাফিয়া আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম বাহলাবি , পৃষ্ঠা ২২
  20. The Difference Between Salafiyyah and the Neo-Salafis – Dr. Bilal Philips
  21. Ibn al-Uthaymeen – “The Salafi Sect” Vs. The Way of the Salaf
  22. Advice to the (Neo) Salafis – Abu Mussab Wajdi Akkari
  23. The Maliki Argument for not Clasping the Hands During Prayer – Abdullah Bin Hamid Ali
  24. Why Do the Malikis Pray With Their Hands to The Sides? – Suhaib Webb
  25. The Risala – A treatise on Maliki Fiqh – Imam Al-Qayrawani Al-Maliki
  26. Following a Madhab – Mufti Abdur Rahman bin Yusuf 
  27. Difference of Opinion in Islam – Anwar Al-Awlaki
  28. Hanafi Usool Al Fiqh – Muhammad ibn Adam Al-Kawthari
  29. Seerah Part 14 (Torture and Prosecution of the Weak) – Yasir Qadhi
Seerah Part 74 (Incidents Before the Conquest of Makkah) – Yasir Qad

            ****************

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

Islamic world

  Islamic World

জনপ্রিয় লেখা সমূহ