সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন মার্কিন মনোবিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেছেন রক গান শোনার কারণে ছেলে মেয়েরা হিংস্র খুনি হয়ে ওঠে। এক তরুণী তার বাবা মাকে হত্যা করে ফেলেছে কোনো কারণ ছাড়াই। পরে তাকে নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হলে দেখা গেল তার মস্তিষ্কে কেবল রক গানের মিউজিক ঘুরছে। মিউজিকটি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে দেখা গেল তাতে বলা হচ্ছে কিল্ হিম্, কিল্ হার। কিল্ ইয়োর ফাদার কিল্ ইয়োর মাদার। কিল্ কিল্ কিল্। কিল্ হিম্ কিল্ হার। দেখা যাচ্ছে এসব মিউজিকের কোনো অর্থ বোঝা না গেলেও অবচেতনে এটি মানব মস্তিষ্কে বিভিন্ন ম্যাসেজ দিতে পারে। চেতন মনের চেয়েও যা অধিক কাজ করে।নবীজীর সাহাবিদের যুগেই পবিত্র কোরআন অনারব সব অঞ্চলে প্রবেশ করে। সাহাবিরা কখনও এমন ফতোয়া দেননি যে, কোরআন না বুঝে পড়লে কোনো সওয়াব হবে না।
তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়ি থেকে নিয়ে চৌদ্দশ বছর ধরে একজন মনীষীও এমন ফতোয়া দেননি। কিন্তু সময় বদলেছে। ইদানিং দেখতে পাচ্ছি কিছু স্কলার বলতে চাচ্ছেন আরবি কোরআন যদি কেউ আরবি থেকে না বোঝে তাহলে তার জন্য আরবি না বুঝে তেলাওয়াতের চেয়ে বাংলা বা ইংলিশ ট্রান্সলেট পড়া অধিক উত্তম।
বিভিন্ন হাদীসে কোরআন পড়ার যে ফজীলতের কথা রয়েছে তা এই বাংলা বা ইংরেজিতে পড়লেও অর্জিত হবে। আর আরবি না বুঝে তেলাওয়াত করলে বিন্দু মাত্র ফায়দা নেই, সওয়াবও নেই। কারণ কোরআনকে বলা হয়েছে হেদায়াত ও পথনির্দেশ। যদি কেউ না বুঝে কোরআন পড়ে তাহলে তোতা পাখির মত উচ্চারণ করার দ্বারা তার জন্য কোনো পথনির্দেশ সে অর্জন করতে পারছে না। কাজেই তার কোনো সওয়াব হবে না। অর্থহীন যারা খতমের পর খতম করছে অথচ একটি আয়াতের অর্থও বুঝতে পারছে না তারা এত খতম না করে একটি সুরা বাংলা বা ইংলিশ তরজমা দেখে পড়লে আরও বেশি সওয়াব লাভ হবে।
এর সপক্ষে তারা নানা যুক্তি উপস্থাপন করছেন। কোরআন হাদীস থেকেও দলীল দেয়ার চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, ‘না বুঝেও কোরআন পড়লে সওয়াব হবে’ এমন একটি আয়াত বা হাদীস নেই। অথচ না বুঝে পড়লে সওয়াব হবে না এমন কোনো দলীলও তাদের সামনে নেই। মূলত যেসব বর্ণনায় কোরআন পাঠের সওয়াবের কথা লেখা আছে সেগুলোতে বুঝে বা না বুঝে এমন কোনো কথা যুক্ত নেই।
সে হিসেবে যে কোনো ভাবেই পাঠ করুক বর্ণিত সওয়াব অর্জিত হবার কথা। কুতর্ক করে তারা বলছেন, ‘না, এখানে পড়ার দ্বারা বুঝে পড়া উদ্দেশ্য।’ অথচ কেরাআত ও তেলাওয়াতের অর্থ আরবি অভিধানসমূহের কোথাও বুঝে পড়ার কথা নেই।
সমাজের কিছু মানুষ এমন আছে যারা একজীবন পার হয়ে যায় কখনও পবিত্র কোরআন বোঝার চেষ্টাটুকুও করেন না। অথচ তারা দ্বীনদার। কেবল তেলাওয়াতেই সন্তুষ্ট থাকেন। অন্য নতুন শ্রেণী গড়ে উঠছে, যারা কখনও তেলাওয়াত করবেন না। না বুঝে তেলাওয়াতকে অনর্থক মনে করেন। বাংলা বা ইংরেজি থেকে তরজমা পড়ে কোরআন চর্চা করেন। এই দুই দলই প্রান্তিকতার শিকার।
প্রথম দল কোরআনকে বরকত মনে করছেন। কোরআন অবশ্যই বরকতের। কিন্তু এই বরকতের পূর্ণতা এটি বুঝে সে অনুযায়ী আমল করার মাঝে। নিঃসন্দেহে তারা কোরআনের বিধান আলেমদের কাছ থেকে শুনে আমল করছেন। কিন্তু তারা ইচ্ছা করলে নিজেরা বুঝে বিধানসমূহের জ্ঞান অর্জন করতে পারতেন। তাদের এ জ্ঞান চর্চার দ্বারা হৃদয় প্রশস্ত হতো এবং অন্তর আলোকিত হতো। তাদের ভেতর অন্যরকম এক নুরানিয়াত ও রুহানিয়াত তারা উপলব্ধি করতে পারতেন। এই বিরাট অর্জন থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
দ্বিতীয় দল কোরআনকে অন্য সাধারণ বই পুস্তকের মত মনে করছেন, যা না বুঝে পড়লে কোনো উপকারিতা নেই। মূলত তাদের ইমানের ত্রুটি রয়েছে।
পবিত্র কোরআনের আছে তুলনাহীন এক সুর আর ছন্দ। কবিতার ছন্দ নয়, অপার্থিব অলৌকিক এক তাল লয় ও শৈলী। হৃদয়ের পরতে পরতে রেখাপাত করে যায় এর শব্দের ঝংকার।
অন্তরে দোলা দিয়ে যায় কোরআনের তেলাওয়াত। কি যে মধু মাখা। কি যে স্বাদ আর গন্ধ। সত্যি পবিত্র কোরআনের সেই স্বাদ যে পায়নি তার জীবনটা শুষ্ক মরুভূমি। অশান্ত জীবনে কোরআনের একটি আয়াতের তেলাওয়াত এনে দিতে পারে পরম শান্তি।
কোরআন পড়তে পড়তে সুফি সাধকরা চলে যান আরশে আযীমের কাছে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, সুফিবাদের এসব কথা হয়ত নাও বুঝতে পারি কিন্তু আমরা কোরআন তেলাওয়াতের স্বাদ হৃদয়ঙ্গম করতে পারি যে কোনো সময়।
বুঝুক আর না বুঝুক সে তো পাঠ করছে মহান মালিকের কালাম। সাত আকাশের ওপর থেকে আসা এক অনন্য বাণী। যা স্রষ্টার পক্ষ থেকে নাযিল । পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে কোরান হেদায়েত ও বাইয়িনাত। এ থেকেই এ দ্বিতীয় শ্রেণীর সরল মুসলিমরা এটাকে কোরআনের একমাত্র বৈশিষ্ট্য মনে করে বসে আছেন অথচ এ বৈশিষ্ট্যের পূর্বে আল্লাহ সবখানে প্রধান বৈশিষ্ট্য নিজেই বলে দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে, উনযিলা, আনযালা, নাযযালা, নুযযিলা..। অর্থাৎ কোরআন এমন এক গ্রন্থ যা সপ্তাকাশের ওপার থেকে আরশে আযীম ও লাওহে মাহফুজ থেকে মুহাম্মাদের সিনা মুবারকে নাযিল হয়েছে। মুনাযযাল মিনাল্লাহ। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।
মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এর প্রতিটি শব্দ আল্লাহর কালাম। এ কালাম কোনো সৃষ্ট বস্তু নয়। পবিত্র কোরআনে অসংখ্য আয়াতে একথা ঘোষণা করা হচ্ছে।
পাঠকারী কোরআন পাঠের সময় এ ইমান নিয়ে যখন পাঠ করে তখন না বুঝলেও প্রতিটি আয়াত তার ভেতর যিকর হিসেবে প্রবেশ করে। বের হয় তাকওয়ার রূপ নিয়ে।
কারণ যতই যে পড়ে ততই তার ভেতর তাকওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়। তবে এর পূর্ণতা হয় যদি সে বুঝে আত্মনিমগ্ন হয়ে পড়তে পারে। কোরআনের কোনো তুলনা নেই, তার কালামেরও কোনো তুলনা
দিন দিন কোরআন আমাদের মাঝ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাদীসে আছে কেয়ামতের আগে একসময় কোরআনকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হবে। সেসময় কোরআন খুলে কেবল সাদা পাতা দেখতে পাবেন।
আল্লাহর কালাম আল্লাহ রাখবেন না। এমন দিন আসার আগেই কোরআন পড়তে শিখুন। যারা তেলাওয়াত শিখেছেন তারা এর অনুবাদ পড়ুন। আর সবচেয়ে ভালো হয় আরবি ভাষা শিখে সরাসরি আরবি কোরআন বোঝার চেষ্টা করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন।
আমিন ।
Source :Jugantor