নিয়তের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
পটভূমি ঃ প্রতিটি কাজের পূর্বে আমাদের সংকল্প করতে হবে- কাজের উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি । কাজের উদ্দেশ্য যদি ভালো হয় তাহলে ফলাফল ভালো হয় । উদ্দেশ্য যদি খারাপ হয়, ফলাফলো খারাপ হয় । নিয়তের উপর হাদীসটি ইমাম বুখারী তার সহীহ বুখারীতে সংকলন করেছেন ।
ইমাম বুখারীর পূর্ণ নাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম ইবনুল মুগিরাহ ইবনে বারদিযবাহ আল বুখারী। আসল নাম মুহাম্মদ হলেও আবু আব্দুলাহ নামে পরিচিত।হাদীস বিষয়ক প্রধান গ্রন্থের অন্যতম গ্রন্থ –‘আল জামেউস সহীহহুল মুসনাদু মিন উমরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি’ । এই গ্রন্থটি কুরআনের পরেই নির্ভুল গ্রন্থ হিসেবে সারাবিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে ।
ইমাম বুখারী ছয় লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে যার মধ্যে এক লাখ সহীহ হাদীস ছিল। মোট ছয় লাখ হাদীস থেকে ষোল বছর যাচাই বাছাই করে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। বুখারী শরীফে মোট ৭৩৯৫ টি হাদীস সংকলিত হয়েছে । পুনারাবৃত্তি ছাড়া এ সংখ্যা মাত্র ২৪১৩ টি । তাহলে সহজে বুঝা যায় যে , কতটা সতর্কতার সাথে এ কাজটা করতে হয়েছে । যে কারনে বুখারী শরীফের সব হাদীস সহীহ ।
নিয়তের হাদীস
ইমাম বুখারীর ৭৩৯৫ হাদিসের মধ্যে সর্বপ্রথম যে হাদীস বর্ণনা করেছেন সেটি হল-
আলকামা ইবন ওয়াক্কাস আল লায়সী(র) থেকে বর্ণিত , আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব(রা) কে মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি আল্লাহর রাসূলুল্লাহ(সাঃ) কে ইরশাদ করতে শুনেছিঃ
”সব কাজ নিয়ত(অভিপ্রায়) অনুযায়ী হয়। আর প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে তাই পায় । কাজেই যার হিজরত দুনিয়া লাভের বা কোনো মেয়েকে বিবাহ করার নিয়তে হয়েছে তাঁর হিজরত উক্ত উদ্দেশ্যেই হয়েছে ।”০১
সিয়া সিত্তার বা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি আছে ।
হাদীসটির প্রেক্ষাপট ঘটনা
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন: আমাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি আমেনা উম্মে কায়স নামের এক মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো । ঐ মহিলা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের শর্তে বিয়েতে রাজী হয়েছিলো এবং লোকটি হিজরত করেন। যেখানে সাহাবীগণ আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হিজরত করেছেন সেখানে এ লোকটি হিজরত করেছে বিয়ের উদ্দেশ্যে। নবী কারীম (সা.) এ ঘটনাটি অবগত হওয়ার পর এ হাদিসটি অবতারণা করেন এবং বলেন সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।
হাদীসটির রাবী পরিচিতিঃ
নামঃ হযরত উমর(রাঃ)
মূল নামঃ উমর
উপনামঃ হাফস
উপাধিঃ ফারুক
পিতার নামঃ খাত্তাব ইবনে নুফায়েল
মাতার নামঃ হানতাম বিনতে হিশাম
জন্মঃ ৫৮৩ খ্রীঃরাসুল (সাঃ) জন্মের ১৩ বছর পর ।
ইসলাম গ্রহণঃ তিনি ৬১৬ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন । তাঁর পূর্বে ৩৯ জন ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাঁকে দিয়ে ৪০ জন পূর্ণ হয় । এর পর মক্কার মুসলমান প্রকাশ্যে নামাজ পড়া শুরু করেন ।
খিলাফতের দায়িত্বঃ হিজরী ১৩ সনের ২২ শে জমাদিউসসানি মোতাবেক ১৩ ই আগস্ট ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ এ আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্যুর পর খুলাফায়ে রাশেদিনের দ্বিতীয় খলিফা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।
“উমর ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল–ফারুক (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়। আমীরুল মু’মিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম উমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। নামের মিল থাকার কারণে পরবর্তী কালের উমাইয়া খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযকে দ্বিতীয় উমর হিসেবে সম্বোধন করা হয়। সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে সুন্নীদের কাছে আবু বকরের পর উমরের অবস্থান। শিয়া সম্প্রদায় উমরের এই অবস্থান স্বীকার করে না। এছাড়াও তিনি ছিলেন ইসলামের নবী মুহাম্মাদের শ্বশুর, অর্থাৎ ওমরের মেয়ে হাফসা ছিলেন মুহাম্মাদের স্ত্রী।
উমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তার শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়। তিনি পূর্বের খ্রিষ্টান রীতি বদলে ইহুদিদেরকে জেরুজালেম এ বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন।“ [০২ ]
জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্তঃ জীবিত থাকা অবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত।
মৃত্যুঃ আবু লুলু নামে পরিচিত এক পার্সিয়ান দাসের ছুরির আগাতে ৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রীঃ, ২৬ জিলহজ্জ ২৩ হিজরি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা মৃত্যু বরন করেন । তাকে মসজিদে নবীতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) এর পাশে দাফন করা হয় ।
বুখারী শরীফে হযরত উমর(রাঃ) বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৬০ টি ।০৩
নিয়ত অর্থঃ ইচ্ছা করা, মনস্থ করা, সংকল্প করা। কোন কাজ শুরু করার পূর্বে নিয়ত করা অপরিহার্য। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তার নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে কাজ করার সংকল্পকে নিয়ত বলা হয় । নিয়তের শর্ত ৩ টি
১. মুসলিম হওয়া
২. ভালো মন্দ পার্থক্য করার বয়স হওয়া।
৩. যে জিনিসের নিয়ত করবে সে বিষয়ে জ্ঞান থাকা ।
ইবাদতের ক্ষেত্রে দুইটি শর্ত ১। আল্লাহর সন্তুষ্টি ২. রাসূল (সাঃ) এর পদ্ধতি
বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত আমল সঠিক,পরিপূর্ণ ও পুণ্যবহ হতে পারে না।
হিজরত অর্থঃ পরিত্যাগ করা ,ছেড়ে দেওয়া। এক বস্তু হতে অন্য বস্তুর দিকে প্রস্থান করাকে হিজরত বলা হয়। ইসলামী শরীয়তে হিজরত দু’ভাবে হতে পারে ।
১. ভয়-ভীতি, নির্যাতন-নিপীড়ন ভূ-খণ্ড হতে শান্তিপূর্ণ ভূ-খন্ডে চলে যাওয়া । রাসূল(সাঃ) ও তাঁর একান্ত অনুসারী আবু বকর (রাঃ) আল্লাহর নির্দেশক্রমে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন ।
২. কোন ভূ-খণ্ডে কাফেরদের প্রভাব এতো বেশি যে ঈমান ও আমল রক্ষা করা কঠিন বা অসম্ভব সেখান থেকে মুমিনদের প্রভাবিত নিরাপদ ভূ-খণ্ডে হিজরত করে চলে যাওয়া একান্ত যুক্তিযুক্ত।
আল কুরআনে নিয়তের ব্যাপারে আল্লাহ্ তায়ালা যা বলেন,
“বলে দাও প্রত্যেকেই নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ী কাজ করে।” ০৪
অন্য আয়াতে আল্লাহ্তায়ালা বলেনঃ
“যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেই, যা আমি চাই, যার জন্য চাই। তারপর তাঁর জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়। এর যে আখিরাত চায় তাঁর জন্য যথাযথ চেষ্টা করে মুমিন অবস্থায়, তাদের চেষ্টা হবে পুরস্কারযোগ্য।”০৫
আল্লাহ্ তায়ালা আরো বলেনঃ
“যে পরকালীন ফসল চায় তার ফসল বৃদ্ধি করে আর যে দুনিয়ার ফসল চায় তাকে দুনিয়া হতেই দান করি কিন্তু পরকালে তার কিছুই প্রাপ্য হবে না। “০৬
নিয়তের ব্যাপারে তাবে-তাবেয়ীর মতামত
প্রসিদ্ধ তাবে-তাবেয়ী সুফিয়ান সাওরী (১৬১ হি.) বলেন –
”কাজ ছাড়া কথার মূল্য নেই। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কথা ও কাজের কোনো মূল্য নেই।”০৭
নিয়তের ব্যাপারে ইমামদের মতামত
ইমাম বুখারী বলেন-
রাসূল করীম (সাঃ)এর হাদিসের মধ্যে এ হাদিসের (নিয়তের) চেয়ে অধিক উপকারী আর কোন হাদিস নেই ।
আবূ দাউদ বলেন-
আমি পাঁচ লক্ষ হাদীস লিখেছি। ৫ লক্ষ হাদীসের মধ্যে বাছাই করে ৪৮০০ লিখেছি। এর মধ্যে উম্মতের জন্য চারটি হাদীসই যথেষ্ট। চার হাদীসের মধ্যে প্রথম হাদীস হলো উল্লেখিত হাদীস।
ইমাম আহমদ বলেন-
এ হাদীসটি ইসলামের এক তৃতীয়াংশ ।
সালাফদের মতামত
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদি বলেন-“আমি যদি কোনো বই রচনা করতাম , তবে আমি বইটির প্রত্যেক অধ্যায়ের শুরুতে উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত নিয়তের রেয়াতটি উল্লেখ করতাম।“ ০৮
ইহাহিয়া ইবনে আবু কাসির বলেন- “খালেস নিয়ত অর্জন করতে শিখো। কেননা আমলের চেয়ে নিয়তের গুরুত্ব বেশি।“ ০৯
হাদীসের ব্যাখ্যা,
নিয়ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য হলো ইবাদতকে অভ্যাস থেকে পৃথক করা । যেমন গরমে আমরা গোসল করি পরিচ্ছন্নতার জন্য। আবার ফরজ গোসল করে থাকি ইবাদত করার জন্য ।
এই হাদীসে বর্ণীত মূলনীতি যেমন বড় বড় কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন তেমনি ব্যক্তি জীবনে দৈনন্দিন ছোটখাট কাজে কর্মে এ মূলনীতি প্রয়োজন।
যদি কেউ আতর সুগন্ধির জন্য ব্যবহার করে, তবে তা পরিপাটির উদ্দেশ্যে ব্যবহার । এটি একটি মুবাহ কাজ হইবে। উহাতে সয়াবও গুনাহের প্রশ্নই আসে না । আর যদি কেউ নিজের অহংকার ,বড়ত্ব প্রকাশ করার জন্য জনসম্মুখে ব্যবহার করে তবে তা জঘন্য । আবার যদি নারী বা পুরুষের চিত্তাকর্ষণে ব্যবহার করে তবে এই সুগন্ধি তাঁর জন্য গুনাহ হবে।
আর যদি কেউ রাসূল (সাঃ) সুগন্ধি পছন্দ করতেন এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা লোক সমাজে গেলে লোকেরা খারাপ গন্ধে কষ্ট পাবে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন তবে এই সাধারণ কাজেও অনেক সওয়াব পাওয়া যাবে।
পানি পান করা, খাবার গ্রহণ করার সময় আমরা যদি নিয়ত করি এই খাবার গ্রহণের করার শক্তি দিয়ে নেক কাজ করার তাহলে খাবার গ্রহণের সওয়াব লাভ করা যাবে । এভাবে আমাদের পড়াশোনা, বিয়ে, চাকুরী সবকিছুতে সওয়াব লাভ করা সম্ভব যদি আমরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি । আমরা যদি কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার পর যে টিপস দেই সেটা যদি লোক দেখানো হয় তাহলে সওয়াব পাওয়া যাবে না কিন্তু যদি আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য করি তাহলে সওয়াব পাওয়া যাবে ।
কোন লোক বিপদে পড়ছে তাকে আমি সাহায্য করব একমাত্র আল্লাহ্ জন্য।আল্লাহকে খুশি করার জন্য। লোকে কি বলবে এ কারণে সাহায্য করব না।
সমাজে প্রচলিত ধারণা -বয়স হয়েছে যদি দাঁড়ি না রাখি লোকে কি বলবে?
টাকা পয়সা হয়েছে যদি হজ্জ না করি লোকে কি বলবে?
সমাজের এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি দান না করলে লোকে কি বলবে ?
সবাই রোজা রাখে , রোজা না রাখলে লোকে কি বলবে?
এভাবেই আমরা আমাদের ফরজ ইবাদত করে যাচ্ছি।
বিশুদ্ধ নিয়তের প্রতিদান
ইবনে সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত
রাসূল(সাঃ) বলেছেন ” আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তুমি যা ব্যয় করবে, তোমাকে তার বিনিময় দেয়া হবে । এমনকি যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে( তার প্রতিদান পাবে ) ।”১০
আবূ হুরাইরা(রাঃ) থেকে বর্ণিত
“এক ব্যভিচারী মহিলা কোনও এক গরমের দিনে একটি কুকুরকে একটি কূপের পাশে চক্কর দিতে দেখতে পেল। কুকুরটি পিপাসায় তার জিহবা বের করে হাঁপাচ্ছিল। তখন সে তাঁর (চামড়ার) মোজা দ্বারা তাঁর পানি তুলে আনল এবং পান করাল । ফলে আল্লাহ্ তার গুনাহ মাফ করে দিল।” ১১
ইবনু ‘উমার (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
” একদা তিন ব্যক্তি হেঁটে চলছিল। এমন সময় প্রবল বৃষ্টি শুরু হলে তারা এক পাহাড়ের গুহায় প্রবেশ করে। হঠাৎ একটি পাথর গড়িয়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দেয়। তাদের একজন আরেকজনকে বলল; তোমরা যে সব ‘আমল করেছ, তার মধ্যে উত্তম আমলের ওয়াসীলা করে আল্লাহর কাছে দু‘আ কর। তাদের একজন বলল, ইয়া আল্লাহ! আমার অতিবৃদ্ধ পিতামাতা ছিলেন, আমি (প্রত্যহ সকালে) মেষ চরাতে বের হতাম। তারপর ফিরে এসে দুধ দোহন করতাম এবং এ দুধ নিয়ে আমার পিতা-মাতার নিকট উপস্থিত হতাম ও তাঁরা তা পান করতেন। তারপরে আমি শিশুদের, পরিজনদের এবং স্ত্রীকে পান করতে দিতাম। একরাত্রে আমি আটকা পড়ে যাই। তারপর আমি যখন এলাম তখন তাঁরা দু’জনে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সে বলল, আমি তাদের জাগানো পছন্দ করলাম না। আর তখন শিশুরা আমার পায়ের কাছে (ক্ষুধায়) চীৎকার করছিল। এ অবস্থায়ই আমার এবং পিতা-মাতার ফজর হয়ে গেল। ইয়া আল্লাহ! তুমি যদি জান তা আমি শুধুমাত্র তোমার সন্তুষ্টি লাভের আশায় করেছিলাম তা হলে তুমি আমাদের গুহার মুখ এতটুকু ফাঁক করে দাও, যাতে আমরা আকাশ দেখতে পারি। বর্ণনাকারী বলেন, তখন একটু ফাঁকা হয়ে গেল। আরেকজন বলল, ইয়া আল্লাহ! তুমি জান যে, আমি আমার এক চাচাতো বোনকে এত ভালবাসতাম, যা একজন পুরুষ নারীকে ভালবেসে থাকে। সে বলল, তুমি আমা হতে সে মনস্কামনা সিদ্ধ করতে পারবে না, যতক্ষণ আমাকে একশত দ্বীনার না দেবে। আমি চেষ্টা করে তা সংগ্রহ করি। তারপর যখন আমি তার পদদ্বয়ের মাঝে উপবেশন করি, তখন সে বলে ‘‘আল্লাহকে ভয় কর’’। বৈধ অধিকার ছাড়া মাহরকৃত বস্তুর সীল ভাঙবে না। এতে আমি তাকে ছেড়ে উঠে পড়ি। (হে আল্লাহ) তুমি যদি জান আমি তা তোমারই সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে করেছি, তবে আমাদের হতে আরো একটু ফাঁক করে দাও। তখন তাদের হতে (গুহার মুখের) দুই-তৃতীয়াংশ ফাঁক হয়ে গেল। অপরজন বলল, হে আল্লাহ! তুমি জান যে, এক ফারাক (পরিমাণ) শস্য দানার বিনিময়ে আমি একজন মজুর রেখেছিলাম। আমি তাকে তা দিতে গেলে সে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। তারপর আমি সে এক ফারাক শস্য দানা দিয়ে চাষ করে ফসল উৎপন্ন করি এবং তা দিয়ে গরু ক্রয় করি এবং রাখাল নিযুক্ত করি। কিছুকাল পরে সে মজুর এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে আমার পাওনা দিয়ে দাও। আমি বললাম, এই গরুগুলো ও রাখাল নিয়ে যাও। সে বলল, তুমি কি আমার সাথে উপহাস করছ? আমি বললাম, আমি তোমার সাথে উপহাস করছি না বরং এসব তোমার। হে আল্লাহ! তুমি যদি জান আমি তা তোমারই সন্তুষ্টির উদ্দেশে করেছি, তবে আমাদের হতে (গুহার মুখ) উন্মুক্ত করে দাও। তখন তাদের হতে গুহার মুখ উন্মুক্ত হয়ে গেল ।”১২
নিয়ত বিশুদ্ধ না থাকার পরিণতি
নিয়ত বিশুদ্ধ না থাকার কারণে অনেকে অনেক আমল করার পরেও কোনও সওয়াব পাবে না। তাই আমাদের সবার নিয়ত যাতে সঠিক থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নীচে কয়েকটা হাদীস দেওয়া হলেও যা থেকে আমরা জানতে পারব নিয়ত সঠিক না থাকলে পরিণতি কি হতে পারে।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
“যে ইলম দ্বারা পরাক্রমশালী মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, সে ইলম যে ব্যক্তি কেবল দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য হাসিল করলো, সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।”১৩
আবু উমামা আল বাহিলি (রাঃ) হতে বর্ণিত ,
“তিনি বলেন এক ব্যক্তি রাসূল(সাঃ) এর কাছে এসে বললেন “ ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনি কী বলেন, যে ব্যক্তি সওয়াব এবং সুনামের জন্য জিহাদ করে, তার জন্য কী রয়েছে ? রাসূল(সাঃ) বললেন “তার জন্য কিছুই নেই” । সে ব্যক্তি তা তিনবার পুনারাবৃত্তি করলেন। রাসূল(সাঃ) তাকে(একটি কথাই) বললেন, “তার জন্য কিছুই নেই”। তারপর তিনি রাসূল(সাঃ) বললেন “আল্লাহ্ তাআলা তাঁর জন্য কৃত খাঁটি (একনিষ্ঠ) আমল ব্যতীত –যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই উদ্দেশ্য না হয় , আর কিছুই কবুল করেন না ।”১৪
সুনামের জন্য জিহাদ, জ্ঞান দান ও অর্থ দান এর পরিণতি
ইয়াহইয়া ইবনু হাবীব আল হারিসী (রহঃ) … সুলায়মান ইবনু ইয়াসার (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা লোকজন যখন আবূ হুরায়রা (রাঃ) এর নিকট থেকে বিদায় নিচ্ছিলো, তখন সিরিয়াবাসী নাতিল (রহঃ) বললেন, হে শায়খ! আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট থেকে শুনেছেন এমন একখানা হাদীস আমাদেরকে শুনান। তিনি বললেন, হ্যাঁ (শুনাবো)।
আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি,
“কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন একজন যে শহীদ হয়েছিল। তাঁকে হাযির করা হবে এবং আল্লাহ তাঁর নিয়ামত রাশির কথা তাকে বলবেন এবং সে তাঁর সবটাই চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে।) তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ এর বিনিময়ে কি আমল করেছিলে? সে বলবে, আমি আপনার (সন্তুষ্টির) জন্য যুদ্ধ করেছি এমন কি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বরং এ জন্যেই যুদ্ধ করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে বলে তুমি বীর। তা তো বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেওয়া হবে। সে মতে তাকে উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে-যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কুরআন অধ্যায়ন করেছে। তখন তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তা’আলা তার প্রদত্ত নিয়ামতের কথা তাকে বলবেন এবং সে তা চিনতে পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে) তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ এত (বড় নিয়ামত পেয়ে বিনিময়ে) তুমি কি করলে? জবাবে সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি এবং তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনারই (সন্তুষ্টি লাভের) উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যায়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি তো জ্ঞান অর্জন করেছিলে এজন্যে যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলে। কুরআন তিলাওয়াত করেছিলে এ জন্যে-যাতে লোকে বলে সে একজন ক্বারী। তা বলা হয়েছে। তারপর আদেশ দেওয়া হবে এবং তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে যাকে আল্লাহ তা’আলা স্বচ্ছলতা এবং সর্ববিধ সম্পদ দান করেছেন। তাকে হাযির করা হবে এবং তাকে প্রদত্ত নিয়ামত সমূহের কথা তাঁকে বলবেন। সে তা চিনতে পারবে (স্বীকারোক্তি করবে।) তখন তিনি (আল্লাহ তায়ালা) বলবেনঃ এর বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছো? জবাবে সে বলবে, সম্পদ ব্যয়ের এমন কোন খাত নেই যাতে সস্পদ ব্যয় আপনি পছন্দ করেন অথচ আমি সে খাতে আপনার (সন্তুষ্টির) জন্যে করিনি। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি বরং এ জন্যে তা করেছিলে-যাতে লোকে তোমাকে “দানবীর” বলে অবিহিত করে। তা বলা হয়েছে। তারপর নির্দেশ দেওয়া হবে, সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”১৫
হাদীস থেকে শিক্ষা
১। প্রতিটি কাজের শুরুতে সহি নিয়াত করা।
প্রত্যেক আমলের গুরুত্ব দেওয়া, লোক দেখানো ইবাদত থেকে দূরে থাকা, গোপন ইবাদত প্রকাশ না করা।
মহান আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের প্রত্যেককে প্রতিটি কাজ ও ইবাদাত রাসূল(সাঃ) এর সুন্নত অনুযায়ী আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করার তাওফীক দান করুক । সকল ভালো কাজের শুরুতে আমাদের সহি নিয়াত করার তাওফীক দান করুক। আমিন ।
তথ্যসূত্রঃ
০১ বুখারী শরীফ, হাদীস নং০১ -আধুনিক প্রকাশনী
এছাড়া হাদিস নং ৫৪,২৫২৯,৩৮৯৮,৫০৭০,৬৬৮৯,৬৯৫৩ তে বোখারী শরীফের বর্ণনা করা হয়েছে ।
সহিঃ মুসলিম হাদীস নং-১৯০৭
সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং-২২০১
সুনানে তিরমিজি হাদীস নং-১৬৪৭
সুনানে নাসাঈ হাদীস নং -৭৫
সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং-৪২২৭
[০২]https://bn.wikipedia.org
০৩ বুখারী শরীফ- আধুনিক প্রকাশনী
০৪ বনী ইসরাইল:৮৪
০৫ বনী ইসরাইলঃ ১৮-১৯
০৬ আল শুরাঃ ২০
০৭ শাতেবী, আল –ইতিসাম ১/১১-১৯, সুয়ুতী, আল-আমরু বিল ইত্তিবা, পৃ।১৯
০৮ জামিউল উলুম ওয়াল হিকমা; ১/৮
০৯ জামিউল উলুম ওয়াল হিকমা; ১/১৩, হিলইয়াতুল আউলিয়াঃ ৩/৭০
১০ সহি বুখারী-২/১২১৮, মুসলিম ১৬২৮
১১ সহি মুসলিম -৫/৫৬৬৫, অনুরুপ-বুখারি -৫৫৭৫
১২ সহি মুসলিম ৪৮/২৭,হাঃ ২৭৪৩, আহমাদ ৫৯৮১)
সহি বুখারীঃ আধুনিক প্রকাশনীঃ২০৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২০৭৪
১৩ সুনানে আবু দাউদ৩৬৬৪, সুনানে ইবনে মাজাহ ২৫২,শায়খ আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।)
১৪ সুনানে নাসাই ৩/৩১৪২
১৫ সহি মুসলিম-৪৭৭০