কুরআনের আলোকে নামায না পড়া ও নামাযের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিণতি
কোনো কাজের উপর গুরুত্বারোপের একটি পদ্ধতি হল, কাজটি করার জন্য উৎসাহ দেওয়া। আরেকটি পদ্ধতি হল, কাজটি না করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক ও ভীতি প্রদর্শন করা। কোনো কিছুর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এ দুই পদ্ধতির যে কোনো একটি অবলম্বন করা যায়। তবে তা পূর্ণতা পায় যখন উভয় পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
নামাযের উপর গুরুত্বারোপের জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআনে উভয় পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। নামায পড়ার জন্য তিনি উৎসাহিতও করেছেন এবং নামায না পড়ার পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করেছেন। গত দুই সংখ্যায় উৎসাহ দেওয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আমরা ভীতি প্রদর্শনের কয়েকটি দিক সম্পর্কে আলোকপাত করব।
মুনাফিকদের কপটতাপূর্ণ নামাযের নিন্দা
নিফাক ও কপটতা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কুরআনে মুনাফিকদের কপটতার নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। এক স্থানে আল্লাহ তাআলা তাদের চরিত্রের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন-
اِنَّ الْمُنٰفِقِیْنَ یُخٰدِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ ۚ وَاِذَا قَامُوْۤا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا كُسَالٰی یُرَآءُوْنَ النَّاسَ وَلَا یَذْكُرُوْنَ اللّٰهَ اِلَّا قَلِیْلًا.
নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে, অথচ তিনিই তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন। আর তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন অলসতার সাথে দাঁড়ায়। তারা মানুষকে দেখায় আর আল্লাহকে খুব সামান্যই স্মরণ করে। -সূরা নিসা (৪) : ১৪২
এখানে আল্লাহ মুনাফিকদের চারটি চরিত্র তুলে ধরেছেন-
ক. তারা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে।
বলাবাহুল্য, আল্লাহকে ধোঁকা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি সর্বজ্ঞ। কিন্তু মুনাফিকরা কপটতা করে মনে করে তারা আল্লাহকে ধোঁকা দিয়ে ফেলছে; আল্লাহ তাদের কপটতা সম্পর্কে অবগত নন!
খ. তারা অলসতার সাথে নামায পড়ে। নামাযকে বোঝা মনে করে।
গ. তারা মানুষকে দেখানোর জন্য নামায পড়ে; আল্লাহর প্রতিদানের আশায় কিংবা তাঁর আযাবের ভয়ে নয়।
ঘ. তারা নামাযে আল্লাহ্কে খুব সামান্যই স্মরণ করে। অথচ নামায হচ্ছে আগাগোড়া আল্লাহর যিকির ও স্মরণ। যিকিরপূর্ণ সেই ইবাদতেই তারা আল্লাহকে অল্প স্মরণ করে। এ থেকে আন্দাজ করা যায় তারা কত অলস ও উদাসীন!
আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন-
وَمَا مَنَعَهُمْ اَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقٰتُهُمْ اِلَّاۤ اَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَبِرَسُوْلِهٖ وَلَا یَاْتُوْنَ الصَّلٰوةَ اِلَّا وَهُمْ كُسَالٰی وَلَا یُنْفِقُوْنَ اِلَّا وَهُمْ كٰرِهُوْنَ.
তাদের দান কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা কেবল এটা যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে কুফরী করেছে এবং তারা নামাযে আসে (চরম) অলসতার সাথে এবং তারা ব্যয় করে (খুব) অনিচ্ছার সাথে। -সূরা তাওবা (৯) : ৫৪
এ আয়াতে মুনাফিকদের নিফাকের তিনটি দিক উল্লেখ করা হয়েছে-
ক. তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে কুফরী করেছে।
হাঁ, মুনাফিকরা আসলে কাফের। তাদের মধ্যে আর অন্য কাফেরদের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, অন্য কাফেররা অন্তরের মত মুখেও ইসলামকে অস্বীকার করে আর তারা অন্তরে অবিশ্বাস করে মুখে বিশ্বাসের কথা বলে।
খ. তারা চরম অলসতার সাথে নামাযে আসে।
গ. তারা আল্লাহর পথে খুব অনিচ্ছায় অর্থ ব্যয় করে।
আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন-
فَوَیْلٌ لِّلْمُصَلِّیْنَ، الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ ، الَّذِیْنَ هُمْ یُرَآءُوْنَ، وَیَمْنَعُوْنَ الْمَاعُوْنَ۠.
দুর্ভোগ সেই নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্পর্কে উদাসীন, যারা মানুষকে দেখায় এবং নিত্য ব্যবহার্য জিনিসও দেয় না। -সূরা মাঊন (১০৭) : ৪-৭
এখানে আল্লাহ মুনাফিকদেরকে দুর্ভোগের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন, যারা নামায সম্পর্কে উদাসীন। নামাযের প্রতি, নামাযের ওয়াক্তের প্রতি যাদের গুরুত্ব নেই। যারা ইচ্ছা করে বিনা ওজরে নামাযের সময় নষ্ট করে। আর যাই পড়ে কেবল মানুষের ভয়ে পড়ে। যেখানে মানুষের ভয় নেই সেখানে নামায ছেড়ে দেয়।
উপরিউক্ত আয়াতগুলোয় আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের কপটতাপূর্ণ নামাযের নিন্দা করে মুমিন বান্দাদের শিক্ষা দিচ্ছেন তারা যেন আগ্রহ, উদ্যম ও যত্নের সাথে নামায পড়ে এবং তাঁকে স্মরণ ও সন্তুষ্ট করার জন্য পড়ে। নামাযের ব্যাপারে অলসতা, উদাসীনতা ও লৌকিকতা না করে। নামাযে সঙ্গে এহেন আচরণের পরিণতি দুর্ভোগ।
কাফেরদের কুফরী ও নামায না পড়ার উপর ভর্ৎসনা
আল্লাহ কুরআনে কাফেরদের অনেক ভর্ৎসনা করেছেন। এক জায়গায় তাদের নিন্দা করে বলেছেন-
فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلّٰى، وَلٰكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰى، ثُمَّ ذَهَبَ اِلٰۤی اَهْلِهٖ یَتَمَطّٰى، اَوْلٰى لَكَ فَاَوْلٰى، ثُمَّ اَوْلٰى لَكَ فَاَوْلٰى.
সে বিশ্বাস করেনি এবং নামাযও পড়েনি। বরং সে অস্বীকার করেছে ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অতঃপর সে দম্ভ করতে করতে তার পরিবারের কাছে চলে গেছে। দুর্ভোগ তোমার জন্য, দুর্ভোগের উপর দুর্ভোগ। অতঃপর দুর্ভোগ তোমার জন্য, দুর্ভোগের উপর দুর্ভোগ। -সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ৩১-৩৫
এ আয়াতে কাফেরের ভর্ৎসনা করা হয়েছে যে, সে ঈমানও আনেনি এবং নামাযও পড়েনি; বরং কুফরী করেছে এবং আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। উপরন্তু এগুলোর জন্য তার কোনো অনুতাপ নেই; বরং সে অহংকারের সঙ্গে চলে। আয়াতটির শেষে এই কাফেরদেরকে উপর্যুপরি দুর্ভোগের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
কাফেরের নিন্দার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে কুফরী করেছে; ঈমান আনেনি। আর ঈমান ছাড়া আমলের (তা যত বড়ই হোক) কোনো মূল্য নেই। আয়াতটিতে কাফেরের কুফরীর পাশাপাশি নামায না পড়ার নিন্দা করা নামায তরক করার ভয়াবহতা তুলে ধরে। এ থেকে বোঝা যায়, নামায না পড়া গুরুতর পাপ। সকলের উচিত দম্ভ-অহংকার ছেড়ে ঈমান আনা, নামায পড়া। পক্ষান্তরে ঈমান ও নামায থেকে বিমুখ থাকা আল্লাহর কাছে অতি নিন্দনীয় এবং এর পরিণতি ভয়াবহ।
জাহান্নামীদের নামায না পড়ার স্বীকারোক্তি
কুরআনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি পরকালে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হবে। এরকম একটি আলাপ সূরা মুদ্দাসসিরে উল্লেখিত হয়েছে।
আল্লাহ বলেন-
فِیْ جَنّٰتٍ ۛیَتَسَآءَلُوْنَ، عَنِ الْمُجْرِمِیْنَ، مَا سَلَكَكُمْ فِیْ سَقَرَ، قَالُوْا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّیْنَ، وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِیْنَ، وَكُنَّا نَخُوْضُ مَعَ الْخَآىِٕضِیْنَ، وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِیَوْمِ الدِّیْنِ، حَتّٰۤی اَتٰىنَا الْیَقِیْنُ.
তারা (ডানের লোকেরা) জান্নাতে থাকবে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে অপরাধীদের সম্পর্কে, কোন্ জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে দাখিল করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা মিসকীনদের খাওয়াতাম না। আর (অসার) আলাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আমরাও তাতে লিপ্ত হতাম এবং আমরা বিচার দিবসকে অস্বীকার করতাম। পরিশেষে নিশ্চিত বিষয় আমাদের কাছে এসে গেল। -সূরা মুদ্দাসসির (৭৪) : ৪০-৪৭
এখানে জান্নাতীদের জিজ্ঞাসার জবাবে জাহান্নামীরা নিজেরাই তাদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলে দিয়েছে। তাদের এই স্বীকারোক্তি থেকে স্পষ্ট যে, নামায না পড়া, সম্পদের হক আদায় না করা, অসার কথাবার্তায় জড়িত হওয়া এবং বিচার দিবসকে অস্বীকার করার পরিণাম জাহান্নাম।
আল্লাহ কুরআনে জাহান্নামীদের এই স্বীকারোক্তি উল্লেখ করে তাঁর বান্দাদের সতর্ক করছেন- তারা যেন জাহান্নামীদের পথে না চলে। বরং তারা ঈমান আনে। নামায পড়ে। সম্পদের হক আদায় করে। অসার কথাবার্তা এড়িয়ে চলে।
নামায নষ্ট করার নিন্দা
আল্লাহ সূরা মারইয়ামে হযরত যাকারিয়া আ., ইয়াহইয়া আ., ঈসা আ., মূসা আ., হারূন আ., ইবরাহীম আ., ইসমাঈল আ., ইসহাক আ., ইদ্রিস আ.-এর আলোচনা করেছেন। তাঁরা সবাই আল্লাহর মনোনীত বান্দা ও নবী ছিলেন। তাঁদের আলোচনার শেষে আল্লাহ বলেছেন-
فَخَلَفَ مِنْۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ اَضَاعُوا الصَّلٰوةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوٰتِ فَسَوْفَ یَلْقَوْنَ غَیًّا.
তাদের পরে অযোগ্য স্থলাভিষিক্তরা এল, যারা নামায নষ্ট করে ফেলল এবং খাহেশাতের পেছনে পড়ে গেল। সুতরাং তারা শীঘ্রই গোমরাহীর (পরিণামের) সম্মুখীন হবে। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৫৯
এ আয়াতে ওই নবীদের পরে আসা অযোগ্য জাতি-গোষ্ঠীর নিন্দা করা হয়েছে যে, তারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনায় মেতে উঠেছে এবং নামায নষ্ট করে ফেলেছে।
নামায নষ্ট করার একটি ভয়াবহ দিক হল নামায একেবারে না পড়া। এমনিভাবে সময়ের ভেতর না পড়াও নামায নষ্ট করারই অন্তর্ভুক্ত।
এ আয়াত থেকে অনুমান করা যায়, নামায নষ্ট করা কত গুরুতর গোনাহ। এর কারণে এত কঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করা হয়েছে। এটা আমাদেরকে এই বার্তা দেয়, নামাযের ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে এবং সময়মত নামায পড়তে হবে। নামায নষ্ট করা যাবে না। নামায নষ্ট করা গোমরাহী।
আয়াতটি আরো নির্দেশ করে, পার্থিব বিলাসিতা এবং নফসের খাহেশাতে মত্ত হওয়া বৈধ নয়। কারণ এর ফলে মানুষ আল্লাহ থেকে গাফেল ও বিমুখ হয়ে যায়।