“তারা তোমাকে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলে দাও, রুহ আমার রবের হুকুমঘটিত বিষয়। কিন্তু তোমরা সামান্য জ্ঞানই লাভ করেছ।”- [সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৮৫ (প্রথম পর্ব)]
তাফসির : আগের আয়াতে বলা হয়েছিল, মানুষ ব্যক্তিগত কাজকর্মে অভ্যাস ও প্রথার অনুসরণ করে। প্রত্যেকে স্বভাব-প্রকৃতির অনুসরণ করে। মানুষের এই কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে যত দিন তার দেহে রুহ বা প্রাণ থাকে। রুহের হকিকত কী—আলোচ্য আয়াতে সে প্রসঙ্গ আনা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে অন্তত ২৩ বার ‘রুহ’ শব্দ এসেছে। বাংলা ভাষায় এর পরিচিত অর্থ হলো প্রাণ বা আত্মা। কোরআনে রুহ শব্দ প্রধানত তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
এক. ‘রুহ’ হলো সেই অলৌকিক বস্তু, যা মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা হয়। যেমন—আলোচ্য আয়াতে রুহ বা প্রাণের হকিকত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে।
দুই. রুহ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে জিবরাইল (আ.)-এর জন্য। অর্থাৎ কোরআনের কোনো কোনো স্থানে রুহ মানে জিবরাইল (আ.)। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, তোমার রবের কাছ থেকে রুহুল কুদুস [জিবরাইল (আ.)] সত্যসহ কোরআন নাজিল করে…।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১০২)
তিন. কখনো কখনো রুহ শব্দ এসেছে কোরআন ও ওহি বোঝানোর জন্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘এভাবেই আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রুহ তথা আমার নির্দেশ। তুমি তো মানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী…!’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ৫২)
দেখা যায়, যে তিনটি প্রসঙ্গে রুহ শব্দ এসেছে, প্রতিটি প্রসঙ্গই মানুষের জীবন ও মানবসমাজের প্রাণের উৎস।
রুহ এমন অশরীরী বস্তু, যা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীর শক্তি ও সামর্থ্য এই রুহের মধ্যেই লুক্কায়িত। এর প্রকৃত স্বরূপ কেউ জানে না। ইহুদি পণ্ডিতরা একবার নবী করিম (সা.)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। তখনই আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়। (বুখারি, সুরা বনি ইসরাঈলের তাফসির)
প্রশ্নকারীরা জানতে চেয়েছিল রুহ জিনিসটা আসলে কী বা কেমন? কোরআনে এ প্রশ্নের তাত্ত্বিক জবাব দেওয়া হয়নি। শুধু এতটুকু বলে দেওয়া হয়েছে যে রুহ বস্তুগত কিংবা অনুভবগ্রাহ্য কোনো জিনিস নয় যে তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারবে। বরং রুহ সম্পূর্ণ অবস্তুগত একটি জিনিস, যা মহান আল্লাহর নির্দেশঘটিত। রুহের হকিকত বেশির ভাগ মানুষের উপলব্ধিক্ষমতার বাইরে। এই বিশ্বভুবনের সত্যাসত্য সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত। উপলব্ধিক্ষমতাও যৎসামান্য।
রুহের হকিকত নিয়ে মানবসমাজে অনেক মতবিরোধ আছে। রুহ অতি সূক্ষ্ম একটি প্রাণী, যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে রক্ত, গোলাপ ফুলের মধ্যে পানি এবং জলপাইয়ের মধ্যে তেল বিচরণ করার মতো বিচরণ করে। রুহের মাধ্যমেই দেহ জীবিত থাকে। রুহের অবস্থানক্ষেত্র হচ্ছে দেহ। যখন দেহ থেকে রুহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন দেহ থেকে প্রাণও চলে যায়। রুহ সৃষ্ট বস্তু। তবে দেহের মৃত্যুর কারণে রুহ মৃত্যুবরণ করে না। রুহের দেহত্যাগ এবং দেহ থেকে রুহের বের হয়ে যাওয়াই মৃত্যু। তবে রুহ নিঃশেষ হয় না, বরং দেহ ধ্বংস হওয়ার পরও তা অবশিষ্ট থেকে যায়। এই রুহ হয়তো জান্নাতে অথবা জাহান্নামে স্থান পায়।
গ্রন্থনাঃ মাওলানা কাশেম শরীফ