১-ফাতিহা
(1:1)
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
(1:2)
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ
(1:3)
الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِۙ
(1:4)
مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِؕ
(1:5)
اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُؕ
(1:6)
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَۙ
(1:7)
صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ١ۙ۬ۦ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ۠
রুকু-১
1:1
প্রচন্ড দয়ালু, সবসময় দয়ালু আল্লাহ্র নামে [2]
1:2
সকল প্রশংসা ও ধন্যবাদ আল্লাহ্র [3], বিশ্বজগতের প্রভু ও প্রতিপালনকারী [4]
1:3
প্রচন্ড দয়ালু, সবসময় দয়ালু
1:4
বিচার দিবসের মালিক ও অধিপতি [5]
1:5
আমরা শুধু তোমারই ইবাদত ও দাসত্ব করি [6] এবং সাধ্যমতো চেষ্টার পাশাপাশি তোমার কাছেই সাহায্য চাই [7]
1:6
আমাদেরকে সরল, উর্দ্ধগামী পথটি দেখাও
1:7
তাদের পথ যারা তোমার অনুগ্রহ পেয়ে গেছে [9] তাদের নয় যারা রাগের কারণ অথবা যারা পথ হারিয়েছে [10]
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা:
[1] “ফাতিহা” শব্দের অর্থ opening বা উদ্বোধন। সূরা ফাতিহাকে সমস্ত কুরআনের সারমর্ম বলা হয়।
[2] “রহমান” বলতে বোঝায় প্রচন্ড দয়ালু । এটা এমন দয়া যা এই মুহুর্তে করা হচ্ছে, অর্থাৎ এটা ক্রিয়া বুঝায়। রহমান এমন দয়া যা অনুপস্থিতও হয়ে যেতে পারে। যেমন – আল্লাহ যখন আমাদের শাস্তি দেন, তখন সেখানে আল্লাহর দয়া অনুপস্থিত থাকে।
অন্যদিকে “রহিম” বলতে বোঝানো হয় যে দয়া সবসবময় থাকে। যেমন – সর্বদাই কোনো না কোনোভাবে আমরা আল্লাহর দয়ার ছায়ায় থাকি। রহিম কাজ করে বিশেষণের মতো – আল্লাহ দয়ালু – অর্থাৎ কিনা আল্লাহ সবসময় দয়ালু।
[3] “হামদ” শব্দের দুটি অর্থ হয় – প্রশংসা ও ধন্যবাদ। লক্ষ্যণীয়, এই বাক্যটির একটি স্বাভাবিক গঠন হতে পারত – “আমি/আমরা আল্লাহ্র প্রশংসা করি”। কিন্ত সেক্ষেত্রে আল্লাহ্র প্রশংসা ও ধন্যবাদপ্রাপ্তি আমাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যেত। তা না করে কুরআনে বাক্যটি এমনভাবে গঠন করা হয়েছে যাতে আল্লাহ্র প্রশংসা ও ধন্যবাদ প্রাপ্তিকে কোনো কিছুর উপর নির্ভরতাহীন ও চির সত্য রূপে বলা হয়েছে। কারণ, মহান আল্লাহর প্রশংসা কোনো প্রাণী বা বস্তুর মুখাপেক্ষি নয়।
সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করা ও তাঁকে মেনে নেয়ার সর্বপ্রথম ধাপ হচ্ছে কৃতজ্ঞতাবোধ। যারা নাস্তিক ও অবিশ্বাসী তাদের মূল বিষয়টা হলো স্রষ্টার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতাবোধের অভাব। যে স্রষ্টা মানুষকে প্রাণ দিলেন, প্রজ্ঞা দিলেন, ভালোবাসা ও রিজিক দিলেন – সেই স্রষ্টাকে অস্বীকার করা বা চেনার চেষ্টা না করা চরম অকৃতজ্ঞতা, আর তাই ইসলামে শিরক সবচাইতে বড় অপরাধ।
[4] “রব” শব্দের অনেক অর্থ হয় – স্রষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক, উপহারদানকারী, রক্ষনাবেক্ষণকারী ও প্রতিপালনকারি। তবে রব শব্দের মূল যে অর্থ এখানে প্রযোজ্য তা হলো – প্রভু ও প্রতিপালক । আল্লাহ্ আমাদের প্রভু আর আমরা তাঁর দাস। একজন দাস ২৪ ঘন্টাই তার প্রভুর দাস। দাস কখনো তার প্রভুর আদেশ-নিষেধের বাইরে কিছু করতে পারে না। পৃথিবীতে কোনো দাস তার মালিকের অবাধ্য হলেই শাস্তি পায়। কিন্তু আল্লাহ দয়াময়, তাই তাঁর দাসেরা বারবার ভুল করা সত্ত্বেও তিনি তাদের মাফ করতে থাকেন, তাদের গুনাহগুলো অন্যদের থেকে গোপন করে রাখেন। আমৃত্যু দাসকে তাওবাহ করার সুযোগ দেন –তিনি যে রহমান ও রহিম। আল্লাহর ইবাদত (ritual) করতে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের সমস্যা নেই, কিন্তু আল্লাহর দাসত্ব করা আমাদের জন্য অনেক বেশী কঠিন। কারণ, দাসত্ব করতে হলে অনেক ছাড় দিতে হয়, নিজেকে অহংকারমুক্ত হতে হয় এবং নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন দিতে হয়। ইবাদত করা কয়েক মিনিটের কাজ, কিন্তু দাসত্ব করা ২৪ ঘন্টার দায়িত্ব।
[5] এর আগে আল্লাহ বলছিলেন – আমরা তাঁর প্রশংসা করব ও তাঁকে রব বলে মানব – কারণ তিনি রহমান ও রহিম – তিনি দয়াময়। আর এবার তিনি জানিয়ে দিলেন – তিনি কিন্তু বিচারও করবেন। কাজেই আমরা যদি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং তাঁকে আমাদের রব না মানি – তিনি বিচারের মাধ্যমে আমাদের প্রাপ্য শাস্তি আমাদেরকে বুঝিয়ে দিবেন।
লক্ষ্যণীয় – আল্লাহ নিজেকে বিচারক বা বিচারের মালিক বলেননি, বলেছেন বিচার দিবস তথা সময়ের মালিক। নিজেকে সময়ের মালিক দাবি করা একমাত্র আল্লাহকেই মানায়। আর, যেহেতু আল্লাহ পুরো দিবসটির মালিক – কাজেই এদিন যতকিছু হবে, যে যা বলবে-করবে, যত সুপারিশ হবে, যা পুরষ্কার বা শাস্তি প্রদান করা হবে – তার সবকিছুই হবে আল্লাহর হুকুমে।
আরেকটা বিষয় হলো: এখানে আরবী “মালিক” শব্দটিকে দুইভাবে উচ্চারণ করা যায় – “মা-লিক” (এক আলিফ টান সহ) ও মালিক (টান ছাড়া)। মা-লিক শব্দের অর্থ হলো স্বত্বাধিকারী (owner) বা সোজা বাংলায় মালিক। আর “মালিক” শব্দের অর্থ হলো রাজা (King) বা অধিপতি। অর্থাৎ বিচার দিবসের স্বত্ব ও কর্তৃত্ব – দুইটাই কেবল আল্লাহর। আবার আরেকভাবে চিন্তা করলে –বিশাল কিছুর ওপর কর্তৃত্ব বুঝাতে আমরা রাজা / অধিপতি শব্দটি ব্যবহার করি, আর সাধারণ কিছুর উপর কর্তৃত্ব বুঝাতে আমরা মালিক শব্দটি ব্যবহার করি। আল্লাহ বিচার দিবসের মালিক ও অধিপতি – অর্থাৎ সেদিনের বড় ও ছোট সবকিছুরই পূর্ণ কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহর।
[6] আরবী ইবাদত বলতে – প্রার্থনা ও দাসত্ব দুইই বুঝায়
[7] আরবী ইস্তি’আনা বলতে বুঝায় – নিজের সাধ্যমতো চেষ্টার পাশাপাশি সাহায্য চাওয়া
[8] “সিরাত” এমন একটি পথ যা সরল, লম্বা ও প্রশস্ত। সরল মনে মানুষ যা চিন্তা করে তার সাথে এই পথ মিলে যাবে – কাজেই এটা সরল পথ। এই পথ প্রশস্ত, যত মানুষ আসতে চায় আসতে পারবে; তবে যাত্রাটা হবে দীর্ঘ। সিরাতের কোনো বিকল্প রাস্তা হয় না – অর্থাৎ আল্লাহকে পেতে হলে এই এক পথেই (অর্থাৎ ইসলামের পথে) পাওয়া যাবে।
“মুস্তাকিম” বলতে বোঝায় সোজা হয়ে দাঁড়ানো। এর আরো অর্থ হলো – ভারসাম্যমূলক ও উর্দ্ধগামী। আমরা আল্লাহর কাছে সিরাতুল মুস্তাকিম চাচ্ছি – অর্থাৎ এমন এক উর্দ্ধমূখী সরল পথের দিশা চাচ্ছি যা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে পার্থিব সংকীর্নতা থেকে, লোভ-লালসার মধ্যাকর্ষীয় শক্তি থেকে সমূলে বিচ্ছিন্ন করে বিশাল আকাশের দিকে নিয়ে যাবে, কিন্তু আমাদেরকে এমন ভারসাম্য শেখাবে যে আমরা আমাদের পৃথিবীর জীবনের দায়িত্বগুলোও সমান তালে পালন করতে পারব। সিরাতুল মুস্তাকিম আমাদেরকে খোদা-ভীরু ও দায়িত্ববান হতে শেখায়, চরমপন্থী হতে নিষেধ করে।
[9] এই আয়াতে আল্লাহ অতীতকাল ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ যারা সরল পথের উপর মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কথা বলছেন। কারন, আজ যে ব্যক্তি সরল পথে আছে, আগামীকালও যে সে তা থাকতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
[10] আগের আয়াতে বলা হয়েছিল সুপথপ্রাপ্ত শ্রেনীর কথা। আর এই আয়াতে বলা হচ্ছে আরো দুই শ্রেণীর কথা – “মাগদুব” ও “দল্লিন”। “মাগদুব” হলো তারা – যাদের মধ্যে সঠিক ও ভুল পথের পার্থক্যমূলক জ্ঞান আছে, কিন্তু তারপরেও তারা ভুল পথকেই বেছে নেয়, অবাধ্যতাকে বেছে নেয়। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময়ে ইহুদীরা এই শ্রেণির ছিল – কারণ তারা সত্য নবী বুঝার পরেও তাঁকে মেনে নেয়নি।
এই আয়াতে যখন রাগের কথা বলে হয়েছে – তখন “মাগদুব” দের উপর কে রাগ করেছে তা উহ্য রাখা হয়েছে। কিছু না বলেও বলে দেয়া ভালো সাহিত্যের একটি গুণ। “মাগদুব”দের প্রতি আল্লাহর রাগ এতই বেশী যে তাদের উপর কে কে রেগে আছে আল্লাহ তা নির্দিষ্ট করে বলার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। আয়াতের প্রেক্ষাপট (context) অনুসারে বোঝা যায় – “মাগদুব”রা মহান আল্লাহ, ফেরেশতা ও মুমিনদের রাগ ও অসন্তোষের কারণ।
আর “দল্লিন” হলো যারা পথ হারিয়েছে, যারা ঠিকমতো জানে না, বোঝে না এদের কী করা উচিত, সঠিক পথ সম্পর্কে এদের কাছে যথেষ্ট জ্ঞান নেই। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সময়ে খ্রিষ্টানরা এই শ্রেণির ছিল – কারণ ধর্ম সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল না। তাদের কিতাব বিকৃত হয়ে পড়েছিল বহু আগেই এবং কী করা উচিত তা তারা বুঝত না।
স্কলারেরা বলেন – উপরে বর্ণিত এই তিন শ্রেনী তিনটি ভিন্ন গোষ্ঠি হতে পারে, আবার একই লোক এই তিন শ্রেণীতেই পড়তে পারে। উদাহরনস্বরুপ বলা যায় – যখন আমরা আল্লাহর ইবাদত করি ও প্রতিনিয়ত আল্লাহর দেয়া আদেশ-নিষেধ মাথায় রেখে কাজ-কর্ম করি তখন আমরা সরল পথে থাকি। আবার সেই আমিই যখন গুনাহ হবে জেনেও কোনো পাপকাজে জড়িয়ে পড়ি, তখন আমি “মাগদুব”-দের একজন। আর, জীবনের কোনো বিষয়ে আমি যা করছি সেটা হালাল বা হারাম তা যদি না জেনে থাকি এবং জানার চেষ্টা না করে নিজের মনমতো চলতে থাকি – তখন আমি পথহারা “দল্লিন”।
আমরা কেউ যদি ইসলামের আলোর সন্ধান পাওয়ার পরেও বারবার আল্লাহর অবাধ্যতা করি বা নিজেকে “মাগদুব”দের অন্তর্ভুক্ত করি, তাহলে মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের কাজের শাস্তিস্বরূপ আরেক স্তর নামিয়ে দিয়ে “দল্লীন” করে ফেলতে পারেন, যখন আমাদের হৃদয়ে এমন মোহর লেগে যাবে যে আমরা আর আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার ভয় পর্যন্ত করব না। আল্লাহ আমাদেরকে এহেন বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
উস্তাদ নুমান আলি খানের লেকচার অনুসরণ করে অনুবাদটি করা হয়েছে – যেখানে আরবী শব্দগুলোকে কেবল আক্ষরিক অনুবাদ না করে ভেঙে বোঝানোর চেষ্টা করানো হয়েছে।