শাসন কর্তৃত্বের আসনে তিনি সমাসীন
তাঁর জ্ঞান সৃষ্টি জগতকে বেষ্টন করে রয়েছে
সৃষ্টির ক্ষুদ্রতম বিষয় ও তাঁর কাছে গোপন নেই
দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সবকিছুই তাঁর আয়ত্বে
আল্লাহ তায়ালা কত কাছে ?
অতীত ,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে
তাঁর অজ্ঞাতে একটি পাতাও পড়ে না
সৃষ্টি কাজে কেউ অংশীদার ছিল না
আল্লাহর সৃষ্টি উদ্দেশ্যহীন নয়
নিস্প্রাণের মাঝে তিনিই প্রাণ দানকারী
তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন
রাত ও দিনকে তিনি যদি দীর্ঘ করে দেন
সমস্ত কিছুর ভান্ডার আল্লাহরই হাতে
তিনিই ভাগ্য নির্ধারণকারী
তিনিই সৃষ্টিতে ভারসাম্যতা রক্ষা করেছেন
তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবগত।
আল্লাহ কোথায় আছেন ?
গোটা আকাশ ও যমীনে যা কিছু রয়েছে সমস্ত কিছুই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের । এই আকীদার প্রশ্নে মুসলমানকে বুঝতে হবে জানতে হবে আল্লাহ কোথায় আছেন ? এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে একটি মারাত্মক বিভ্রান্তি । কোরআন ও সহীহ হাদীসে এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে , তবুও না জানার কারণে মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। যে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিপালন করছেন ,তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। অনেকে বলে থাকেন যে , মহান আল্লহ তা’য়ালা সর্বত্র বিরাজমান এবং হাজির নাজির। এই ধারণা ও বিশ্বাস সঠিক নয়, কোরআন ও হাদীসের বিপরীত । কোরআন -হাদীসের দৃষ্টিতে সঠিক কথা হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অবস্থান আরশের ওপর কিন্তু তিনি তাঁর অসীম জ্ঞান ,ক্ষমতা ,কুদরত ও দেখা শোনার মাধ্যমে সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান নন।
আল্লাহ কোথায় আছেন ,এই প্রশ্নের জবাব কোনো মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না বিধায় স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালাই তাঁর বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন ,তিনি কোথায় আছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতা’য়ালা নিজের অবস্থান সম্পর্কে সাতবার বলেছেন যে, তিনি আরশে আযীমে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রসঙ্গ উল্লেখ র্পূবক মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন- () এরপর স্বীয় আরশের ওপর আসীন হয়েছেন । (সূরা আল আ’রাফ -৫৪ )
এই একই বিষয় আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা ইউনুস ,সূরা রা’দ ,সূরা ত্বাহা , সূরা ফোরকান ,সূরা সিজদা ও সূরা হাদীদে উল্লেখ করেছেন। সমস্ত কিছু সৃষ্টি করার পর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন -আল্লাহ তা’য়ালার এ কথার বাস্তব রূপ অনুধাবন করা কোন মানুষের পক্ষে কক্ষণই সম্ভব নয়। তবে একটি বিষয় আল্লাহ তা’য়ালা এই কথার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্ব এবং এর বাইরে যা কিছু রয়েছে ,এসব সৃষ্টি করে আল্লাহ তা’য়ালা ক্লান্ত হয়ে পড়েননি বা তিনি সৃষ্টি কাজ সমাপ্ত কের তাঁর সৃষ্টি থেকে তিনি সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেননি। তিনি নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে অচেতন , বেখবর ,অসজাগ ,অসতর্ক বা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেননি। অথবা সৃষ্টি করে তিনি তার সৃষ্টি জগৎ পরিচালনার দায়িত্ব ও কারো প্রতি অর্পন করেনি। এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়ার লক্ষেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে,তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন । অর্থাৎ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোটা মহাবিশ্বেও শুধুমাত্র সৃষ্টি কর্তাই নন, তিনি এই মহাবিশ্বেও প্রতিপালক ,নিয়ন্ত্রক ,ব্যবস্থাপক ,পরিচালক ,পর্যবেক্ষক ,সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজন পূরণকারী ,আবেদন শ্রবণকারী, দোয়া কবুলকারী এবং সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজনীয় আইন কানুন ও বিধান দানকারী।
আল্লাহ তা’য়ালা আরশের ওপর সমাসীন হয়েছেন এই বিষয়টি মানুষকে জানিয়ে দিয়ে তিনি এ কথাই স্পস্ট করে দিয়েছেন যে. তিনি এই মহাবিশ্বকে অস্তিত্বশীল করে অবসর গ্রহণ করেননিএবং মহাবিশ্ব থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে যাননি। বরং মহাবিশ্ব লোকের ক্ষুদ্র থেকে সর্ববৃহৎ অংশ পর্যন্ত সবস্তরের বিষয়াদিও ওপর কর্তৃত্ব তিনিই করছেন। শাসন কার্য পরিচালনা ও সার্বভৌমত্বও সমস্ত ক্ষমতা ও ইখতিয়ার একমাত্র তাঁরই মুষ্ঠিতে নিবদ্ধ। মহাবিশ্ব ও এর বাইরে যা কিছু রয়েছে ,সবকিছু তাঁরই অধীন ও মুখাপেক্ষী । প্রত্যেকটি অণু পরমাণু তাঁর বিধানের অধীনে ক্রিয়াশীল । সৃষ্টিসমূহের ভাগ্য চিরস্থায়ীভাবে তাঁর বিধানের অধীনে বন্দী।
আল্লাহতা’য়ালা কয়েকটি স্তরের মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে আরশে সমাসীন হয়েছেন এই কথার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর মানুষের কাছে এ কথা স্পস্ট করে দিয়েছেন যে ,তাঁর সৃষ্টি কাজে যেমন কারো কোনো অংশীদার ছিলনা ,অনুরূপভাবে সৃষ্টি কাজের পরিচালন ,প্রতিপালন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কারো সমান্যতম অংশীদারিত্ব নেই। তাঁর আরশ বা সিংহাসন যা সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে ,সেখানে থেকেই তিনি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। মানুষকেও তিনি স্বাধীন ক্ষমতা দিয়ে ছেড়ে দেননি। মানুষের প্রত্যেকটি স্পন্দনের প্রতি তিনি সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য যেসব বিধি বিধান প্রয়োজন,সে বিধানও তিনি আরশ বা সিংহাসন থেকে অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং মানুষের স্বেচ্ছাচারী হওয়া বা নিজের ভাগ্যেও মালিক নিজেকে মনে করার কোন অবকাশ নেই এই কথাটিই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্পস্ট করে দিয়েছেন এভাবে যে,তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন । অর্থাৎ মূল কেন্দ্রে থেকে তিনিই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ করছেন্ । নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসল্লাম বলেছেন -() নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা নিজ আরশের ওপর রয়েছেন । তাঁর আরশ হচ্ছে সমস্ত আকাশের ওপর । (আবু দাউদ )
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আরশে আসীন হয়েছেন আর আরশ হলো অগণিত আকাশের ওপরে । আল্লাহ তা’য়ালা যে তাঁর মহান আরশে অধিষ্ঠিত এবং আরশ যে ওপরে অবস্থিত এ বিষয়ে কোরআন ও হাদীসে অসংখ্য প্রামণ রয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে- () “ফেরেশতাগণ এবং রুহ আল্লাহ তা’য়ালার দিকে ঊর্ধ্বগামী হয়। (সূরা মায়ারিজ ৪)
তাঁরই দিকে আরোহন করে উত্তম কথা এবং সৎকর্ম তাকে তুলে নেয়। (সূরা ফাতির ১০ )
বরং আল্লাহ তাঁকে (ঈসাকে )উঠিয়ে নিয়েছেন নিজের দিকে । (সূরা আন নিসা ১৫৮ )
বিশ্বমানবতার মুক্তি সনদ মহাগ্রন্থ আল কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে,- এই কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে।
পাশাপাশি কোনো স্থান থেকে বা নীচু স্থানে থেকে কোন কিছু প্রেরণ করা হলে অবতীর্ণ করা করা বুঝায় না। ওপর থেকে কোনো কিছু প্রেরণ করা হলে তা অবতীর্ণ করা বুঝায় । আল্লাহ তা’য়ালা কোরআন সম্পর্কে বলেছেন -() এই একটি কিতাব যা আমি তোমার প্রতি অবর্তীণ করেছি যাতে তুমি মানুষকে অন্ধাকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে এসো। (সূরা ইবরাহীম ১)।
নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতরণ করেছি ,যাতে আল্লাহ তোমাকে যা বুঝিয়েছেন তা দিয়ে তুমি মানুষের মধ্যে শাসন ও ফয়সালা করতে পারো। (সূরা নিসা ১০৫ )
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর বায়তুল মাকদাসকে কিবলা হিসেবে নামায আদায় করতেন। তিনি মনে মনে কামনা করতেন ,মক্কার কা’বাঘরকে যদি কিবলা বানানো হতো । এ জন্য তিনি বার বার আকাশের দিকে দৃষ্টি দিতেন। তাঁর দৃষ্টি দেয়ার অর্থ এটা ছিলো যে,ওপর থেকেআল্লাহতা’য়ালা যদি কোনো আদেশ দিতেন । মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর রাসূলের মনের অবস্থা দেখলেন এবং রাসূলকে জানিয়ে দিলেন- () নিশ্চয়ই আমি তোমাকে বার বার আকাশের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে দেখি । (সূরা বাকারা ১৪৪)
আল্লাহর রাসূলের থেকে মহান আল্লাহর পরিচয় আর কে বেশী জানতে পারে ? তিনিই সব থেকে বেশী আল্লাহর পরিচয় ও অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন । তিনি জানেনে যে ,মহান আল্লাহ তা’য়ালা ওপরে আরশে আযীমে অবস্থান করছেন। এ জন্যই তিনি বার বার ওপরের দিকে তাকাতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে উপস্থিত সমস্ত সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন আল্লাহ পক্ষ থেকে আমার কাছে যা কিছু অবতীর্ন হয়েছে ,আমি কি তা তোমাদের কাছে পৌঁছিয়েছি ? উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ জবাব দিলেন অবশ্যই ।তখন তিনি উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে ইশারা করে আকাশের দিকে শাহাদাত আঙ্গুলি উঠিয়ে বললেন, হে আল্লাহ ! তুমি সাক্ষী থেকো। (মুসলিম )
এ কথা যদি বলা হয় যে,আল্লাহ তা’য়ালা সব জায়গায় আছেন বা তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তাহলে তিনি পাহাড় -পর্বত ,নদী- নালা ,খাল- বিল, হাওড়- সাগর মহাসগর, আকাশ- বাতাস, আগুন -পানি ,ময়লা -আবর্জনার, ভাগাড়, মল -মূত্রের ভান্ড তথা বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত সকল স্তরেই তিনি রয়েছেন । সেসব জায়গা অবাঞ্ছনীয়, অবান্তর সেসব জায়াগতেও আল্লাহকে থাকতে হয়। পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্টি, দুগন্ধময়,অপবিত্র তথা যেখানে বা যে স্থান কোনো মানুষের পক্ষে বাস করা সম্ভব নয় সেখানেও আল্লাহ তা’য়ালা রয়েছে।
হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুয়াবিয়া ইবনে হাকাম আসলামী রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর দাসীকে প্রশ্ন করলেন -() বলো আল্লাহ তা’য়ালা কোথায় ? দাসী জবাব দিলো আল্লাহতা’য়ালা আকাশের ওপর ।তিনি পুনরায় সেই দাসীকে প্রশ্ন করলেন বলো আমি কে ?দাসী জবাব দিলো আপনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন হযত মুয়াবিয়া ইবনে হাকামকে আদেশ দিলেন এই দাসীকে মুক্ত করে দাও। কারণ সে ঈমানদার (মুসলিম )
লিখেছেন- মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদী
সংগৃহিত