মানুষ সৃষ্টির সেরা
বহুকাল
ধরে লোকমুখে এ কথা প্রচলিত ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি, কেন এই শ্রেষ্ঠত্ব?
যদি হয় শক্তি-সামর্থ্যের বিবেচনায়। তবে তো এমন হাজারো প্রাণী
রয়েছে, যারা শক্তি-সামর্থ্যে মানুষকে সহজেই হার মানায়। যদি
বলি বুদ্ধিমত্তায় শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। তবে এমন হাজারো প্রাণী রয়েছে, যাদের বুদ্ধিমত্তা মানুষের থেকে অনেক বেশি প্রখর। গাছের ডালে বাবুই
পাখির পরিকল্পিত ঘর নির্মাণ, পিপীলিকার সারিবদ্ধ পথ চলা
আর মৌমাছির নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন,
বুদ্ধিমত্তার দৌড়ে তারা আমাদের ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই
গণহারে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বলার আগে আরেকবার ভাবা উচিত। কারণ যুক্তির দাবি অনুসারে মানব আকৃতির এই জীবকে অন্য সব সৃষ্টির তুলনায় তখনই
শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া যাবে, যখন অন্যদের তুলনায় তারা বিশেষ
কোনো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। এ কারণে মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এক শ্রেণির
লোকের আলোচনায় বলেন, ‘তারা (মানুষ হয়েও) পশুর মতো,
বরং পশুর চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট।’ (সুরা :
আরাফ, আয়াত : ১৭৯)
উল্লিখিত
আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয়, ব্যাপকভাবে মানুষ বলতেই সৃষ্টির সেরা নয়। বরং
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ পশু থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে থাকে। তাই প্রথমেই খুঁজতে হবে
মানুষ আর পশুর মধ্যে মৌলিক কী পার্থক্য রয়েছে। আর এর মাধ্যমে সহজেই নির্বাচন করা
সম্ভব হবে, কারা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আর কারা মানুষরূপী
পশু কিংবা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। কোরআন সুন্নাহর আলোকে মানুষ ও পশুর মধ্যে মৌলিক
পাঁচটি পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে
ধারাবাহিকভাবে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
এক.
আল্লাহর কুদরতি হাতে মানুষের সৃষ্টি : যখন ইবলিস শয়তান হজরত আদম (আ.)-কে সিজদা করতে অস্বীকার করল তখন মহান আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবলিস! যাকে আমার নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি তাকে সিজদা করতে তোকে কিসে
বাধা দিল?’ (সুরা : সদ, আয়াত :
৭৫)
উক্ত
আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, মানুষের সৃষ্টি মহান আল্লাহর স্বহস্তে সম্পাদিত
হয়েছে। নতুবা আল্লাহ তাআলার সাধারণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া হলো, যখন তিনি কোনো কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তখন আদেশ করেন হও। আর অমনি তা
হয়ে যায়। (সুরা : নাহল, আয়াত :
৪০)
দুই.
তিন. সুষ্ঠু বিবেক ও শুদ্ধ জ্ঞান : দুটি পৃথক বিষয় হলেও একটি অপরটির সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। কারণ শুদ্ধ জ্ঞান ছাড়া বিবেক সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে
পারে না। যেমন—রোগাগ্রস্ত কাউকে দেখে বিবেকতাড়িত হয়ে তার জন্য অনেক
কিছুই করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু চিকিৎসা জ্ঞান না থাকলে এই তাড়না নিষ্ফল। অন্যদিকে
সুষ্ঠু বিবেক ছাড়া শুধু শুদ্ধ জ্ঞানও ফলদায়ক নয়। যেমন—ধূমপান
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জানা সত্ত্বেও সুষ্ঠু বিবেকের অভাবে এ জ্ঞানের কোনো
মূল্যায়ন হয় না। সুতরাং একটি অপরটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
বিবেক
হলো তাই, যা মানুষকে স্বীয় জ্ঞানের আলোকে তার জন্য
সবচেয়ে হিতকর বিষয়টির সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। বিবেকবান বলতে মেধাবী বা
বুদ্ধিমান নয়, বরং মেধা ও বুদ্ধি মানুষের ব্রেইনের সঙ্গে
সম্পর্কিত। এর উদাহরণ মেমোরি কার্ড বা হার্ডডিক্সের সঙ্গে করা যেতে পারে, যা মানুষের জ্ঞান তথা জানা-অজানা তথ্য সংরক্ষণ করে। পক্ষান্তরে বিবেক
বা বুঝশক্তি মানুষের অন্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত। হ্যাঁ, আশ্চর্য
মনে হলেও পবিত্র কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে তা-ই প্রমাণিত হয়। এ কারণেই তো
হার্টের রোগীদের দুশ্চিন্তা পরিহার করে ভালো ভালো বিষয় ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ
বিষয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের অন্তর রয়েছে অথচ
তারা তা দ্বারা উপলব্ধি করে না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৭৯)
এ
ছাড়া বেশ কিছু আয়াতে চিন্তাভাবনার সম্পর্ক মানুষের হার্ট তথা অন্তরের সঙ্গে করা
হয়েছে। আর এটাই বিবেকের মূল কার্যক্রম।
তবে
শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নিছক বিবেক নয়, বরং সুষ্ঠু বিবেকই
বিবেচ্য। সুতরাং বিবেকের সুষ্ঠু ব্যবহার হলো ভালো ভালো বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা।
এ তালিকার প্রথমে রয়েছে মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গবেষণা করা। মহান আল্লাহ বলেন,
‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি? তবে
তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতো।’
(সুরা : হজ, আয়াত : ৪৬)
দ্বিতীয়ত, পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ
বলেন, ‘তারা কি কোরআন সম্পর্কে মনোযোগসহ চিন্তাভাবনা করে
না, নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ!’ (সুরা : মুহাম্মাদ, আয়াত : ২৪)
লক্ষ
করুন,
ওপরে উল্লিখিত দুটি আয়াতে চিন্তাভাবনার সম্পর্ক অন্তরের সঙ্গে করা
হয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ ও পবিত্র কোরআনের
গবেষণার মধ্যে সুষ্ঠু বিবেকবানদের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে।
চার.
মানুষ পৃথিবীর দায়িত্বশীল : মহান আল্লাহ সৃষ্টিকুলের সব কিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি
করেছেন। করেছেন মানুষের অনুগত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মহান আল্লাহ সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য
পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৯)
সুতরাং
আল্লাহ প্রদত্ত এই অধিকার যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশ গড়ে
তোলা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর যারা এই দায়িত্বের অবহেলা করে
কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশ কলুষিত করে, তারা মানবতার শত্রু। পশুর চেয়েও জঘন্য।
পাঁচ.
মহান আল্লাহর ইবাদত : এই বিষয়টিকে পূর্ববর্তী বিষয়ের সম্পূরক বা পরিপূরক বলা যেতে
পারে। কেননা মৌলিকভাবে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশ গঠনে একটি পরিকল্পিত গঠনতন্ত্রের
প্রয়োজন, যার আলোকে পৃথিবীর সব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত
হবে। অন্যথায় যে যার মনমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে পরিবেশ আরো অশান্ত করে ফেলতে
পারে। এবং প্রত্যেকেই মনে করবে আমি তো ঠিকই করছি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
‘যখন তাদের বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কোরো না তখন তারা বলে আমরা বরং শান্তি প্রতিষ্ঠা করছি। শুনে রাখো,
নিশ্চয়ই তারাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অথচ তারা বুঝতেও পারে না।’
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১-১২)
তাই
উক্ত গঠনতন্ত্র প্রণয়নের ভিত্তি কারো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিংবা দূরদর্শিতার ওপর
নয়। নয় কারো ধারণা বা গণনার ওপরেও। কারণ অভিজ্ঞতা পরিবর্তনশীল আর দূরদর্শিতাও
বিচিত্রময়। বরং তা এমন সত্তার পক্ষ থেকে প্রণীত হতে হবে, যাঁর কাছে পৃথিবীর শুরুর দিনটি যেমন স্পষ্ট, শেষের
দিনটিও তেমনি স্পষ্ট। এই দীর্ঘযাত্রার সব সুবিধা-অসুবিধা যাঁর নখদর্পে রয়েছে। আর
এই বৈশিষ্ট্যের একক অধিকারী শুধু মহান রাব্বুল আলামিন। সুতরাং তিনিই নিজ প্রজ্ঞাগুণে
মানবজাতির সফলতার দিকনির্দেশনা হিসেবে যুগে যুগে আসমানি কিতাব প্রেরণ করেছেন। এবং
পবিত্র কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ করার মধ্য দিয়ে কিয়ামত অবধি সব মানুষের চূড়ান্ত
সফলতার পথ ও পন্থা বাতলে দিয়েছেন। অতএব মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের বিধি-নিষেধের পূর্ণ
পরিপালনের মধ্যেই মানবজাতির প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত।