০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

সালাত কি কেন?

 পরকালের মুক্তির জন্য চারটি কাজ জরুরী ভাবে করতে হবে:-

১। বিশুদ্ধ নিয়ত বা প্রতিজ্ঞা, 

২। নিয়মিত নামাজ আদায়, 

৩। হালাল উপার্জন, 

৪। সৎ কাজ। 

নামাজকে কোরআনের ভাষায় সালাত বলে। সালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দরুদ বা শুভকামনা, তাসবিহ বা পবিত্রতা বর্ণনা, রহমত তথা দয়া বা করুণা, ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা। কর্তাভেদে ও স্থান কাল পাত্রভেদে সালাতের বিভিন্ন অর্থ হয়। সালাতের কর্তা যদি আল্লাহ হন, তাহলে সালাতের অর্থ হয় দয়ামায়া। সালাতের কর্তা যদি ফেরেশতা হন, তাহলে এর অর্থ হয় রহমত বা দয়া কামনা অথবা কারও জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা। আর সালাতের কর্তা যদি ইনসান বা মানুষ হয়, তাহলে এর অর্থ হয় ক্ষমাভিক্ষা, রহমত প্রার্থনা ও শুভকামনা। এই সালাত শব্দটি সালয়ুন ধাতু থেকে নির্গত। যার অর্থ হলো আগুনে পুড়ে কোনো বস্তুকে নির্ধারিত আকার দেওয়া। বিশেষ করে বেত, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তির ও ধনুকের ছিলা তৈরি করা। সালাতের এসব আভিধানিক অর্থের সঙ্গে এর অন্তর্নিহিত আবেদনের মিল রয়েছে।

সালাত শব্দের পারিভাষিক অর্থ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট ইবাদত সম্পাদন করা। এর মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত হলো ফরজ, যথা: ফজর বা ভোরের সালাত; জোহর বা দ্বিপ্রহরের সালাত; আসর বা বিকেলের সালাত; মাগরিব বা সান্ধ্যকালীন সালাত; ইশা বা রাত্রকালীন সালাত।


সালাতের নির্দেশ ও পরিপ্রেক্ষিত

সালাতের নির্দেশ আল্লাহ থেকে মিরাজের সময় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। সালাত (নামাজ) মুসলিম জীবনের অপরিহার্য একটি বিষয়, যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, বৈষয়িক, ইহলৌকিক, পারলৌকিক, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এবং স্বীয় সত্তা ও সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধবিশেষ। হায়াতের প্রতিটি পরতে-পর্যায়ে ও স্তরে সালাতের সঙ্গে সময় সম্পৃক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন, নিঃসন্দেহে সালাত বিশ্বাসীদের ওপর সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে আবশ্যকীয় করা হয়েছে। (সূরা নিসা, আয়াত-১০৩)।

সালাত সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা দিয়ে, দায়িত্বপরায়ণতার দীক্ষা দিয়ে, পবিত্র অনুভব ও আবেগের এমন এক স্বর্ণালি শৃঙ্খল রচনা করে, যা আপাতদৃষ্টিতে মানুষকে কেবল শৃঙ্খলিতই করে না; উপরন্তু তা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে পবিত্র দাসত্বের বন্ধনের মাধ্যমে অপরাপর সব বন্দিত্ব থেকেও মুক্তি দেয়। সালাতের প্রতিষ্ঠা দীন ও অস্তিত্বের প্রতিষ্ঠা।

সালাতকে অবজ্ঞা করা নিজ অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে সালাত প্রতিষ্ঠা করল, সে দীনকে প্রতিষ্ঠা করল আর যে সালাতকে বিনষ্ট করল, সে দীনকেই বিনষ্ট করল। সালাত মনোদৈহিক তথা মানসিক, মৌখিক ও দৈহিকের সঠিক সমন্বয়ের একটি সমন্বিত ইবাদত। যার সঙ্গে আর্থসামাজিক অন্যান্য বিষয়ও জড়িত। আর্থিক বিষয়টি হালাল রিজিকেরও অন্তর্ভুক্ত এবং হালাল জীবিকা দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে এবং দৈহিক-জৈবিক পবিত্রতা সালাতের মৌলিক ও প্রাথমিক শর্তও বটে।

নামাজের অন্যতম শিক্ষা ‘খুশু–খুজু’ (বিনয় ও নম্রতা)। খুশু-খুজু যা কিনা সালাতের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবহার। আর একাগ্রতাই সালাতকে প্রাণবন্ত করে তোলে। কেবলই অনুভূতিহীন ঠোঁট নড়াচড়া ও ওঠা–বসার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। মনে রাখতে হবে, সালাত পাগল ও শিশুদের ওপর অপরিহার্য নয়। যে ব্যক্তি যত ধীরস্থির, ধ্যান, জ্ঞান, মানসিক, শারীরিক দিক থেকে যোগ্য এবং এমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যে জাগতিক জগতের জায়নামাজে সিজদায় উপনীত হয় বটে, তবে পবিত্র আমেজ ও আবেগে, অনুভূতিতে, চক্ষু মুদে জাগতিক জগতের চৌহদ্দি ভেদ করে আরশের ফরশে সিজদাহকে পৌঁছাতে পারে; সে-ই সালাতকে প্রাণবন্ত করতে পারে। এরূপ সালাত মানুষের সুস্থ চিন্তা, ইমানি জীবনকে পূর্ণতা দেয়। তখন এক ওয়াক্তের সালাতবিহীন সময় জীবনে যে বোধগত শূন্যতা সৃষ্টি করে, সেটাই তার জন্য চরম মানসিক শাস্তির কারণ হয়ে ওঠে। জাহান্নামের শাস্তি, সে তো দূরতম বিষয়।


>আত্মার সঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসা থাকে এবং প্রকৃত আত্মজিজ্ঞাসার সদুত্তর হলো আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা। সেই মহান অস্তিত্বের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হলো নিয়মিত সালাত আদায় করা এবং স্বীয় সালাতের পবিত্র প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পবিত্র জীবন যাপন করা

সালাতের শিক্ষা

সালাত এক দিন, এক বছর বা এক যুগেরও নয়। সালাত প্রতিদিন শিখতে হয় এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে শিক্ষা জারি থাকা উচিত। সালাত প্রতিক্ষণের সুস্থির অনুভব-উপলব্ধি, তিলাওয়াত-তাসবিহ, রুকু-সিজদার জন্য যে তৃষ্ণা তৈরি করে, মৃত্যুর পরও তা বাকি থেকে যায়। সালাতের ব্যবহারিক ও বাহ্যিক দিকগুলো স্বল্প সময়ে আয়ত্তে আনা যেতে পারে, তবে অভ্যন্তরীণ উন্নতির ক্রমধারা যা উপলব্ধি ও সূক্ষ্ম অনুভূতির জন্ম দেয়, তা আমৃত্যু শাণিত করতে হয়। তাই সালাত প্রতিষ্ঠা এবং অব্যাহত শিক্ষার ও অনুশীলনের বিষয়টিও অন্তহীন।

শাণিত ও শাশ্বত সালাত কেবল সালাতই নয়, তা মুমিনের বেঁচে থাকার হৃৎস্পন্দনও বটে। যখন একজন মুসল্লি বা নামাজি আন্তরিকভাবে সালাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন এ সালাত আনুষ্ঠানিক ও লোক দেখানোর বিষয় থাকে না। বরং বেঁচে থাকার অবলম্বনে পরিণত হয়। আত্মার সঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসা থাকে এবং প্রকৃত আত্মজিজ্ঞাসার সদুত্তর হলো আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা। সেই মহান অস্তিত্বের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হলো নিয়মিত সালাত আদায় করা এবং স্বীয় সালাতের পবিত্র প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পবিত্র জীবন যাপন করা। এটাই মূলত জীবনের সর্বক্ষেত্রে সালাত কায়েমের নামান্তর। এভাবেই সালাত একজন মুসল্লির জীবনকে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করে এবং সালাতবিহীন জীবনের হাহাকার দূর করতে সালাতের বিকল্প আর কিছু নেই।

সালাতের সমন্বিত রূপ হচ্ছে অঙ্গসঞ্চালন (যেমন রুকু, সিজদা ইত্যাদি) কোরআন ও তাসবিহ পঠন, অন্তরকে শক্তির প্রতি সমর্পণ। উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ের সমন্বয়কে পূর্ণ সালাত বলে।

ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হলো সালাত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে সালাত প্রতিষ্ঠা করে, সে তার পুরো দীন (জীবনবিধানকে) প্রতিষ্ঠা করে; যে সালাত বিনষ্ট করে, সে পুরো দীনকেই বরবাদ করে দেয়।’ (বুখারি)। কোরআন ও হাদিসে সালাত পড়া নয়, প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সালাত হিসাব করেই সময়ানুবর্তিতার সঙ্গে পড়া আবশ্যক। কেননা, কেয়ামতের দিন সবার আগে সালাতেরই হিসাব নেওয়া হবে। (বুখারি ও মুসলিম)। সালাত পবিত্রতার প্রতীক ও জান্নাতের চাবিকাঠি। (বুখারি ও তিরমিজি)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাত আদায় করে না, ইসলামে তার কোনো অংশ নেই। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত সালাত ত্যাগ করে, সে জাহান্নামি।’ রাসুল (সা.) বলেন, ইমান ও কুফরের মধ্যবর্তী দেয়াল হলো সালাত। সালাত মানবজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে বা নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শিক্ষা দেয়। মানুষ যা দেখে তা শেখে, তা ভাবে। তাই দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ মনোনিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য; এর দ্বারা কর্মও নিয়ন্ত্রিত হয়। এ জন্যই সালাতে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তাকবিরে তাহরিমার সময় দৃষ্টি সিজদার জায়গায়। দাঁড়ানো অবস্থায়ও দৃষ্টি সিজদার জায়গায়। রুকু অবস্থায় দৃষ্টি পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির দিকে। পুনরায় দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সিজদার জায়গায়। সিজদা অবস্থায় দৃষ্টি নাকের আগায়। বসা অবস্থায় দৃষ্টি নাভিতে। সালাম দেওয়ার সময় দৃষ্টি কাঁধে নিবদ্ধ থাকবে। এভাবে সালাত আদায় করলে মনোনিয়ন্ত্রণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে; সালাতের প্রকৃত উদ্দেশ্যও সফল হবে। সালাত সত্যিকারার্থে তার আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ প্রকাশে সার্থক হবে। জীবন ও সমাজ সুন্দর হবে, আল্লাহ তাআলা খুশি হবেন। আল্লাহ পাক সালাত কায়েম করার তৌফিক দান করুন।  আমিন




সংগৃহীত

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

Islamic world

  Islamic World

জনপ্রিয় লেখা সমূহ